ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু পোপ নির্বাচনের এক বিশেষ প্রক্রিয়া হলো ‘কনক্লেভ’। এই কনক্লেভ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘গোপন কক্ষে সভা’। পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়াটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক মজাদার তথ্য।
আসুন, এমনই কিছু অজানা কথা জেনে নেওয়া যাক।
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হলেন পোপ। সারা বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কাছে তিনি ধর্মগুরু এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত।
পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং এর কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ‘কনক্লেভ’-এর মাধ্যমে, যেখানে কার্ডিনালরা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নতুন পোপ নির্বাচন করেন।
ইতিহাসের দীর্ঘতম কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। পোপ চতুর্থ ক্লিমেন্টের উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য কার্ডিনালদের প্রায় এক হাজার ছয় দিন সময় লেগেছিল।
অর্থাৎ, প্রায় তিন বছর! ইতালির ভিটারবো শহরে এই কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কার্ডিনালদের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যেন দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছানো যায়। সেই থেকেই ‘কনক্লেভ’ শব্দটির উৎপত্তি।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই নির্বাচনের চাপ কমাতে পোপ দশম গ্রেগরি ১২৭৪ সালে একটি নিয়ম জারি করেন। সেই নিয়ম অনুযায়ী, কনক্লেভ যদি তিন দিনের বেশি চলে, তাহলে কার্ডিনালদের দৈনিক একটি বেলার খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়।
আর আট দিনের বেশি চললে, তাদের রুটি, জল ও সামান্য পরিমাণে মদ সরবরাহ করার নিয়ম ছিল। যদিও বর্তমানে এই নিয়ম আর কার্যকর নেই।
অন্যদিকে, সবচেয়ে দ্রুততম কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫০৩ সালে, যেখানে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্বাচিত করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস পঞ্চম ব্যালটে এবং ২০০৫ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট চতুর্থ ব্যালটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কনক্লেভ সাধারণত ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত হয়। এই চ্যাপেলের দেয়ালে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর বিখ্যাত ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’ ছবি রয়েছে।
১৪৯২ সালে এই চ্যাপেলে প্রথম কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৮৭৮ সাল থেকে এটি নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পবিত্র স্থানে কার্ডিনালরা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থেকে নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য প্রার্থনা করেন।
ঐতিহাসিকভাবে, কনক্লেভ ভ্যাটিকানের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ইতালির ভিটারবো, পেরুজিয়া, আরেজো এবং ভেনিস; জার্মানির কনস্টাঞ্জ ও ফ্রান্সের লিও-র নাম উল্লেখযোগ্য।
ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনাও ঘটেছে, যখন একাধিক ব্যক্তি পোপ হওয়ার দাবিদার ছিলেন। এদের ‘অ্যান্টিপোপ’ বলা হতো।
১৩৭৮ থেকে ১৪১৭ সালের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা বেশি দেখা যায়, যা ‘ওয়েস্টার্ন স্কিজম’ নামে পরিচিত। ক্লিমেন্ট সপ্তম, বেনেডিক্ট ত্রয়োদশ, পঞ্চম আলেকজান্ডার এবং ২৩তম জন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য অ্যান্টিপোপ ছিলেন।
কনক্লেভের সময় কার্ডিনালদের স্বাস্থ্যবিধির দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হতো। আগে কার্ডিনালরা সিস্টিন চ্যাপেলের কাছেই অস্থায়ী কক্ষে ঘুমাতেন।
১৬ ও ১৭ শতকে কনক্লেভের পরিবেশকে ‘বিস্বাদ ও দুর্গন্ধযুক্ত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা ছিল।
পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি গোপন রাখার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পোপ দশম গ্রেগরি এই গোপনীয়তার ওপর জোর দেন, যাতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে।
কার্ডিনালদের একটি গোপন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো, যাতে তারা স্বাধীনভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
পোপ দ্বাদশ জন ছিলেন সবচেয়ে কম বয়স্ক পোপ, যিনি ৯৫৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, তৃতীয় সেলেস্টাইন (১১৯১ সালে নির্বাচিত) ও পঞ্চম সেলেস্টাইন (১২৯৪ সালে নির্বাচিত) প্রায় ৮৫ বছর বয়সে পোপ নির্বাচিত হয়ে বয়স্কতম পোপের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কার্ডিনাল হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ১৩৭৮ সালের পর থেকে এই প্রথা চলে আসছে।
সর্বশেষ কার্ডিনাল না হয়েও যিনি পোপ হয়েছিলেন, তিনি হলেন ষষ্ঠ আর্বান। তিনি ছিলেন একজন মঠবাসী এবং বারি শহরের আর্চবিশপ।
পোপ নির্বাচনের ইতিহাসে বিভিন্ন দেশের মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়। পোল্যান্ডের জন পল দ্বিতীয়, জার্মানির ষোড়শ বেনেডিক্ট এবং আর্জেন্টিনার ফ্রান্সিস এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য।
পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া শুধু একটি ধর্মীয় আচারই নয়, বরং এটি ক্যাথলিক চার্চের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
এটি ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস