পোপ ফ্রান্সিসের ১২ বছরের শাসনকালের পর, নতুন পোপের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। ভ্যাটিকান সিটি থেকে আসা খবর অনুযায়ী, এই পোপের প্রধান কাজ হবে পুরনো অনেক সমস্যার সমাধান করা।
একদিকে যেমন ভ্যাটিকানের আর্থিক বিষয়গুলো গোছাতে হবে, তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান যুদ্ধ এবং ঐতিহ্যবাদীদের মধ্যে চলা অসন্তোষও তার নজরে রাখতে হবে।
নতুন পোপের সামনে আসা প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নারী অধিকারের বিষয়টি। পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন।
এখন দেখার বিষয়, নতুন পোপ সেই ধারা বজায় রাখেন, নাকি পরিবর্তন আনেন। ক্যাথলিক চার্চের স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য।
তারা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধর্মকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তারা চার্চের ভেতরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে নিজেদের অসহায় মনে করেন, যেখানে পুরোহিততন্ত্র শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত।
এই অবস্থায় অনেক সন্ন্যাসিনী দলবদ্ধভাবে সন্ন্যাস জীবন ত্যাগ করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার সন্ন্যাসিনী কমেছে।
২০২২ সাল শেষে বিশ্বে সন্ন্যাসিনীর সংখ্যা ছিল ৫,৯৯,২২৯ জন, যেখানে ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭,০২,৫২৯। নারীরা চান চার্চের পরিচালনায় তাদের আরও বেশি ভূমিকা থাকুক এবং তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
আর্জেন্টিনার মারিয়া লিয়া জর্বিনো, যিনি নারী বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, তিনি বলেন, “আমরা ঈশ্বরের বিশাল একটা অংশ। এটা শুধু নারীর অধিকারের বিষয় নয়, বরং এটা চার্চের স্বার্থের জন্যও জরুরি।”
এছাড়াও, প্রগতিশীল এবং ঐতিহ্যবাদীদের মধ্যেকার বিভাজনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৬ সালে কার্ডিনাল জর্জ পেলের লেখা একটি চিঠিতে পোপ ফ্রান্সিসের শাসনের সমালোচনা করা হয়েছিল, যেখানে তাঁর শাসনকে ‘বিপর্যয়কর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই চিঠিতে নতুন পোপকে সেই ‘বিপর্যয়’ থেকে পরিত্রাণের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। ঐতিহ্যবাদীরা মনে করেন, পোপ ফ্রান্সিসের আমলে চার্চে বিভাজন বেড়েছে।
তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি এবং বিশ্বস্তদের কথা শোনার উপর জোর দিলেও, পুরনো ল্যাটিন ভাষায় প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। যদিও রক্ষণশীলদের নিজেদের পছন্দসই কাউকে নির্বাচিত করার মতো যথেষ্ট সমর্থন নেই, তবুও নতুন পোপকে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো যাজকদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা। যদিও অনেক চার্চ নেতা মনে করেন এই ধরনের ঘটনা এখন অতীত, তবে নির্যাতিত ব্যক্তি এবং তাদের সমর্থকরা চান নতুন পোপ যেন এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেন।
পোপ ফ্রান্সিস এবং পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শ এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।
যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা চান, এই বিষয়ে ভ্যাটিকান যেন স্বচ্ছতা বজায় রাখে এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
এলজিবিটিকিউ+ (LGBTQ+) সম্প্রদায়ের প্রতি চার্চের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। পোপ ফ্রান্সিস এই সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসার কথা বলেছেন।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “আমি কে বিচার করার?”-এর মাধ্যমে তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। নতুন পোপকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি এই পথে চলবেন নাকি তাঁর নীতিতে পরিবর্তন আনবেন।
উগান্ডার একজন সাধারণ নেতা, গ্যাভার্স ন্দিয়ানাবো, বলেছেন, “আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ ক্যাথলিক চার্চ চাই, তবে আমাদের মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে আপস করা উচিত নয়।” অন্যদিকে, ফাদার জেমস মার্টিন, যিনি এলজিবিটিকিউ+ ক্যাথলিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছেন, তিনি মনে করেন, নতুন পোপের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সেইসব মানুষের কাছে পৌঁছানো, যারা নিজেদের চার্চ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
পোপের এই সিদ্ধান্তগুলো শুধু ভ্যাটিকান সিটির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর প্রভাব সারা বিশ্বের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের উপর পড়বে। তাই নতুন পোপের জন্য অপেক্ষা করছে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস।