পোপ লিওর আগমনে কী আশা ফিলিস্তিনের খ্রিস্টানদের?

পোপ লিও চতুর্দশ-এর কাছে পবিত্র ভূমির খ্রিস্টানদের প্রত্যাশা

নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর, পবিত্র ভূমির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন বেশ আনন্দিত। সেন্ট পিটার-এর উত্তরসূরি হিসেবে পোপ লিও চতুর্দশ-কে অভিষিক্ত করা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, বর্তমান পোপও তাঁর পূর্বসূরি পোপ ফ্রান্সিসের মতোই ন্যায়বিচার ও শান্তির পথে অবিচল থাকবেন।

ঐতিহাসিকভাবে, এই পবিত্র ভূমিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে ভ্যাটিকান সিটি। গির্জার কাজকর্ম থেকে শুরু করে এই অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা, এমনকি আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন—সবকিছুতেই তাদের অবদান রয়েছে। জেরুজালেমের পন্টিফিকাল মিশন, বেথলেহেম বিশ্ববিদ্যালয়, নাজারেথের বেনেডিক্ট সেন্টার—এগুলো তারই প্রমাণ। এমনকি সম্প্রতি গাজায় শিশুদের চিকিৎসার জন্য পোপ ফ্রান্সিস একটি মোবাইল ক্লিনিক প্রদানের মাধ্যমে সহায়তা করেছেন।

পোপদের বিভিন্ন সফর এখানকার মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ১৯৬৪ সালে পোপ ষষ্ঠ পল, ২০০০ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল, ২০০৯ সালে ষোড়শ বেনেডিক্ট এবং ২০১৪ সালে পোপ ফ্রান্সিসের সফর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পবিত্র ভূমির খ্রিস্টানরা চান, পোপ লিও চতুর্দশ শুধু এখানে আসুক তাই নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও সহায়তা করুক, যেখানে খ্রিস্টধর্মের জন্ম। প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের এই সম্প্রদায়টি স্থানীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চায়, এবং অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। তবে তাদের সাহায্য প্রয়োজন।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখানকার খ্রিস্টানদের জীবনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। এটি এই অঞ্চলের অস্থিরতার প্রধান কারণ, যা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার জন্ম দেয় এবং এতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে খ্রিস্টানরাও রয়েছেন।

ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চরমপন্থা বেড়ে যাওয়ায় অনেক সময় তারা নিজেদের জন্মভূমিতেই পরবাসী মনে করেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সংঘাতের কারণে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় জীবনযাত্রার মানও নিম্নমুখী হচ্ছে। অনেকে দেশ ত্যাগ করতে বা ভবিষতে চলে যেতে চাইছে, যা তাদের সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।

স্থানীয় খ্রিস্টানরা চান, ভ্যাটিকান সিটি যেন আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করে। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর শেষ ভাষণে গাজায় শান্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। পোপ লিও চতুর্দশ তাঁর প্রথম ভাষণে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এই ধরনের পদক্ষেপকে তারা স্বাগত জানায় এবং আশা করে, তিনি পবিত্র ভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

ফিলিস্তিনে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে যে ভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, গাজায় চলমান যুদ্ধ এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সীমিত ক্ষমতা—এসব কারণে পরিস্থিতি এখনও অনিশ্চিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করা। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার মানুষের মধ্যে আশা জাগাতে ভ্যাটিকান সিটির পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়েও চার্চের সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে, ইসরায়েলে খ্রিস্টান ও অ-খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যা সমাধানে ভ্যাটিকান সিটি এবং স্থানীয় চার্চ—বিশপ, পুরোহিত ও সাধারণ বিশ্বাসীদের মধ্যে সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে কাজ করে ইসরায়েল সরকারকে তার নাগরিকদের প্রতি সমান আচরণ করতে এবং তাঁদের মর্যাদা রক্ষা করতে চাপ সৃষ্টি করা দরকার।

খ্রিস্টানরা আশা করে, ভ্যাটিকান সিটি তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সহযোগিতা করবে। জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক ইসরায়েলি আইনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা সমর্থন চায়।

এ ছাড়া, ইকরিত ও বিরম গ্রামের মানুষের বেদনাদায়ক সমস্যার সমাধানেও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ১৯৫১ সালে এই দুটি গ্রামের ক্যাথলিক খ্রিস্টান বাসিন্দাদের তাঁদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং পরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়। সেই থেকে বাসিন্দারা এবং তাঁদের বংশধররা তাঁদের পৈতৃক ভূমিতে ফিরে আসার দাবি জানিয়ে আসছেন, কিন্তু তাঁদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ভ্যাটিকান সিটির আরও জোরালো সমর্থন প্রয়োজন। কারণ, তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যেমন—কিছু পৌরসভার পক্ষ থেকে পুরনো চুক্তি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত কর আরোপ, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের খ্রিস্টান স্কুলগুলোতে বৈষম্যমূলকভাবে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করা এবং চার্চের সম্পত্তির প্রতি হুমকি ইত্যাদি।

পবিত্র ভূমির খ্রিস্টানরা আরও চান, পোপ লিও চতুর্দশ তাঁদের মধ্যে ঐক্য বাড়াতে কাজ করুন। বিশেষ করে বড় ধর্মীয় উৎসবগুলো—যেমন ক্রিসমাস ও ইস্টার—পালনের জন্য একটি অভিন্ন তারিখ নির্ধারণের চেষ্টা করা যেতে পারে। এছাড়াও, তাঁরা চান, বিভিন্ন চার্চের মধ্যে যৌথ উদ্যোগে পবিত্র ভূমিতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হোক, যেখানে শুধু ধর্মীয় স্থানগুলো পরিদর্শনই নয়, বরং সেখানকার বিশ্বাসীদের সঙ্গে মতবিনিময়েরও সুযোগ থাকবে। এর মাধ্যমে তাঁরা বিশ্বজুড়ে তাঁদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে এবং বিশ্ব চার্চের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেদের অনুভব করতে পারবেন।

সব মিলিয়ে, পবিত্র ভূমির খ্রিস্টানরা, সারা বিশ্বের খ্রিস্টানদের মতোই, পোপ লিও চতুর্দশ-কে একজন পিতার মতো দেখতে চান—যিনি তাঁদের কাছে আসবেন, তাঁদের কথা শুনবেন, তাঁদের বিপদ থেকে রক্ষা করবেন এবং নিপীড়িত হলে তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন।

পোপ লিও চতুর্দশ-এর জানা উচিত, পবিত্র ভূমিতে তাঁর অনেক সন্তান রয়েছে, যারা তাঁকে ভালোবাসে এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ব্যস্ততা সম্পর্কে অবগত।

পবিত্র ভূমির খ্রিস্টানরা তাঁর মিশনের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। তাঁরা জানেন, কাজটি কতটা কঠিন। তবে সবার উপরে, সন্তানদের প্রয়োজন একজন পিতা—এবং তাঁরা এটাই সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেন: তিনি যেন সবসময় তাঁদের পাশে থাকেন, তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *