পোপ নির্বাচিত হতেই ইহুদিদের মনে আশা! সম্পর্ক উন্নয়নে কতটা সফল লিও?

পোপ লিও চতুর্দশের অভিষেক অনুষ্ঠানে ইহুদি নেতাদের অংশগ্রহণ এবং ক্যাথলিক-ইহুদি সম্পর্কের নতুন দিগন্ত।

ভ্যাটিকান সিটি থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর লিও চতুর্দশের অভিষেক অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে আসন গ্রহণ করেন ইহুদি নেতারা। এই ঘটনাকে নতুন পোপের আমলে ক্যাথলিক এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন অনেকে। বিশেষ করে আগের পোপের সময়ে দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল।

নতুন পোপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের এই সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার কারণ হলো, বিভিন্ন দেশে ইহুদি বিদ্বেষ বেড়ে চলেছে এবং হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের সমালোচনা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের ১.৪ বিলিয়ন ক্যাথলিকের প্রধান হিসেবে পোপের বক্তব্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাব্বি নোয়াম মারান্স, যিনি আমেরিকান ইহুদি কমিটির আন্তঃধর্মীয় বিষয়ক পরিচালক, সংবাদ সংস্থা এপি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এই সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে ইহুদিদের জীবন রক্ষা করা যেতে পারে।’ তিনি জানান, পোপ লিও তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে সংলাপ ও সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। রাব্বি মারান্সের মতে, কোনো আমেরিকান রাব্বিকে এর আগে কোনো পোপ এমন চিঠি দেননি। তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের (Second Vatican Council) পর যুক্তরাষ্ট্রেই ইহুদি-ক্যাথলিক সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।’

আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে, দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল ‘নসট্রা এটেট’ (Nostra Aetate) নামে একটি ঘোষণা প্রকাশ করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে খ্রিস্ট ধর্ম ও ইহুদিদের মধ্যেকার সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। খ্রিস্টানরা একসময় বিশ্বাস করত, যিশুকে হত্যার জন্য ইহুদিরাই দায়ী। ভ্যাটিকান কাউন্সিল সেই ধারণা বাতিল করে এবং ইহুদি বিদ্বেষকে পাপ হিসেবে ঘোষণা করে।

এরপর থেকে ভ্যাটিকান অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে আসছে। ২০১৬ সালে পোপ ফ্রান্সিস রোমের প্রধান সিনাগগে যান। এর আগে ভ্যাটিকান ঘোষণা করে, তারা ইহুদিদের ধর্মান্তরিত করার কোনো চেষ্টা সমর্থন করে না।

তবে, হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের কিছু মন্তব্যে অনেক ইহুদি নেতা হতাশ হয়েছিলেন। ওই হামলায় ১,২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। এরপর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩,০০০ এর বেশি।

পোপ ফ্রান্সিস হামাসের হামলার বার্ষিকীতে দেওয়া এক চিঠিতে গাজার মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন, কিন্তু ইসরায়েল বা ইহুদিদের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। এর এক মাস পরে, তিনি এক সাক্ষাৎকারে গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য তদন্তের আহ্বান জানান।

ইতালির ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী ‘ইউনিয়ন অফ ইতালিয়ান জিউইশ কমিউনিটিজ’-এর প্রেসিডেন্ট নোয়েমি ডি সেগনি বলেন, ‘পোপের গণহত্যা বিষয়ক মন্তব্য আমাদের ব্যথিত করেছে। এটি সত্যিই একটি সংকট তৈরি করেছে।’

অন্যদিকে, নতুন পোপ লিও চতুর্দশ দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ডি সেগনিকে চিঠি লেখেন। ডি সেগনি মনে করেন, পোপের এই পদক্ষেপের ফলে ইতালির ছোট ছোট গির্জারগুলোতেও ইহুদিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়টি উৎসাহিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সেখানকার নেতারা মনে করেন, সরকারি পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বেড়েছে। ডিসেম্বর মাসে আমেরিকান ইহুদি কমিটি এবং ইউএস কনফারেন্স অফ ক্যাথলিক বিশপস যৌথভাবে ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ইহুদি নেতারা পোপ লিও’র আন্তঃধর্মীয় সংলাপে আগ্রহ দেখে উৎসাহিত হয়েছেন। তারা গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি জিম্মিদের বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের প্রশংসা করেছেন।

পোপ লিও তাঁর অভিষেক ভাষণে গাজা, মিয়ানমার ও ইউক্রেনের যুদ্ধ-দুর্গত মানুষের কথা উল্লেখ করেন। তবে ভাষণে জিম্মিদের কথা উল্লেখ না করায় অনেকে কিছুটা হতাশ হয়েছেন।

রাব্বি নোয়াম মারান্স মনে করেন, পোপ লিও সম্ভবত রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে আগের পোপের চেয়ে ভিন্ন সুর বজায় রাখবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি, বন্ধু হিসেবে সরাসরি ও খোলামেলা আলোচনা আবার শুরু হবে।’

তবে, সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো, ইহুদি নেতাদের সঙ্গে এই সংলাপ কিভাবে পবিত্র আসন ও ইসরায়েলের মধ্যেকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

জেরুজালেমের রাব্বি ডেভিড রোজেন, যিনি পোপ লিও’র অভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন এবং আন্তঃধর্মীয় বিষয়ে ভ্যাটিকানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তিনি বলেন, ‘পোপ ফ্রান্সিস একজন ভালো বন্ধু ছিলেন, তবে সবসময় সবকিছু বিবেচনা করতেন না। পোপ লিও’র মধ্যে যুদ্ধের বিষয়ে আরও বেশি সংবেদনশীলতা দেখা যায়।’

ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়ারন সিডম্যান বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দু’জনেই রাজনৈতিক সত্তার চেয়ে অনেক বড় কিছু ধারণ করি। ইহুদিদের সঙ্গে আলোচনাকে সেই রাষ্ট্রের থেকে আলাদা করা যায় না, যেখানে অর্ধেক ইহুদি বসবাস করে। এখানে একটি মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন।’

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *