নতুন পোপ লিও ১৪: পেরুর ‘চিকলায়ো’ থেকে উঠে আসা এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। ক্যাথলিক চার্চের নতুন প্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্ম নেওয়া লিও ১৪-এর অভিষেক হয়েছে।
এই প্রথম কোনো আমেরিকান নাগরিক পোপের দায়িত্ব নিলেন। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পেরুর উত্তরাঞ্চলের শহর চিকলায়োর মানুষের কাছে তিনি একজন আপনজন। খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই শহরটিতে আনন্দের ঢেউ লেগেছে।
পোপ নির্বাচনের আগে, বিশেষ করে গত কয়েক দশকে, চিকলায়ো শহরের সঙ্গে লিও ১৪-এর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি পেরুর উত্তরে বিভিন্ন মিশনে কাজ করেছেন।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি এখানকার বিশপ ছিলেন এবং এই সময়ে তিনি পেরুর নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি ‘পাপা চিকলায়ানো’ বা চিকলায়োর পোপ নামেই পরিচিত।
চিকলায়োর মানুষজনের মধ্যে পোপকে নিয়ে উৎসাহের প্রধান কারণ হলো, সেখানকার মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও সেবার মানসিকতা। স্থানীয় যাজক হোসে আলেহান্দ্রো কাস্টিলো ভেরা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে তাঁর সঙ্গে পোপের প্রথম দেখা হয়।
তিনি বলেন, “তিনি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছেন।” পোপের দায়িত্ব গ্রহণের পর চিকলায়োতে উৎসবের আমেজ লেগেছে।
শহরের প্রধান চত্বরে মানুষজন নাচানাচি করেছে এবং বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে।
পর্যটন সংস্থাগুলো পোপের নামে বিশেষ ট্যুর প্যাকেজ তৈরি করার প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি, সেখানকার রেস্টুরেন্টগুলোতেও ‘আকুই কমিলো এল পাপা’ (এখানে পোপ খেয়েছেন) লেখা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে।
তবে, লাতিন আমেরিকায় ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব কমে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। লাতিনোবারোমেট্রো নামক একটি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ নিজেদের ক্যাথলিক হিসেবে পরিচয় দিতেন।
বর্তমানে সেই সংখ্যা ৫৪ শতাংশে নেমে এসেছে। পেরুতেও, ২০১৫ সালে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর জনসাধারণের মধ্যে চার্চের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।
চিকলায়োর ৭০ বছর বয়সী শিক্ষক ইয়োলান্ডা ডিয়াজ মনে করেন, পোপ লিও ১৪-এর নেতৃত্বে ক্যাথলিকরা নতুন করে জেগে উঠবে। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, তিনি আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে পারবেন এবং চার্চের মধ্যে আমরা যে পরিবর্তনগুলো দেখতে চাই, সেগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।”
পোপ তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর সরাসরি চিকলায়োর মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি স্প্যানিশ ভাষায় দেওয়া ভাষণে বলেন, “আমি বিশেষভাবে আমার প্রিয় চিকলায়ো অঞ্চলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, যেখানে বিশ্বস্ত মানুষজন তাদের বিশপের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের বিশ্বাস ভাগ করে নিয়েছেন এবং যিশু খ্রিস্টের প্রতি অনুগত থেকে চার্চকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন।”
চিকলায়োতে দারিদ্র্য একটি বড় সমস্যা। এখানকার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় এখানকার অনেক পরিবার বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত ছিল।
স্বাস্থ্যখাতেও দেখা দেয় চরম সংকট। এমন পরিস্থিতিতে পোপ লিও ১৪ অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কারিতাস চিকলায়োর সেক্রেটারি জেনারেল ফাদার কাস্টিলো জানিয়েছেন, পোপ স্থানীয়দের সাহায্য চেয়ে একটি তহবিল গঠন করেন।
সেই তহবিলের মাধ্যমে প্রায় ৩৮০,০০০ ডলার সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা দিয়ে দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে সেগুলো বন্ধ রয়েছে।
বর্তমানে পেরু ভেনেজুয়েলার অভিবাসীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। ডিয়াজ জানান, তিনি নিজে এই অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পোপের সঙ্গে মিলে অভিবাসন ও মানব পাচার বিষয়ক একটি নতুন কমিশন তৈরি করতে সহায়তা করেছেন।
তিনি বলেন, “চিকলায়োতে আমরা প্রায় ২০,০০০ অভিবাসী দেখেছি, যাদের মধ্যে ৩,০০০ পরিবারের বেশি ছিল।” তবে, পোপ লিও ১৪-এর ওপর কিছু অভিযোগও রয়েছে।
তিনি যখন চিকলায়োর বিশপ ছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল, যা নিয়ে অনেকে নীরবতা পালন করেছেন বলে অভিযোগ করেন। যদিও পোপ বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
যাইহোক, পোপ লিও ১৪-এর এই নতুন দায়িত্ব নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর নেতৃত্ব কেমন হয়, সেদিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা