পোপ নির্বাচনের পর নতুন নাম গ্রহণের রীতি, এর তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পোপ নির্বাচনের পর নতুন নাম গ্রহণ করেন। এই ঐতিহ্যটি শুধু একটি প্রথা নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ক্যাথলিক ইতিহাসের এক গভীর তাৎপর্য।
নতুন পোপের এই নাম পরিবর্তন, তাঁর শাসনকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে। মধ্যযুগের শুরু থেকে এই রীতি চলে আসছে, যদিও এর কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই, তবুও এটি পোপ নির্বাচনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
তাহলে, কিভাবে এই প্রথার শুরু হলো? বিভিন্ন পোপীয় নামের অর্থ কী? ভবিষ্যতের পোপেরা কী ধরনের নাম বেছে নিতে পারেন? এবং এই নাম ঘোষণার প্রক্রিয়াটি কেমন? আসুন, এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
নতুন নাম গ্রহণের কারণ।
প্রথম পোপ সেন্ট পিটার (Saint Peter), যিনি ছিলেন যিশুর বারো জন শিষ্যের একজন, তাঁর আসল নাম ছিল সাইমন। যিশু খ্রিস্টই তাঁকে এই নতুন নাম দেন।
তবে, তিনি যখন চার্চের প্রধান হন, তার অনেক আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। এরপর, ৫৩৩ থেকে ৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পোপ জন দ্বিতীয় (Pope John II) ‘মার্কিউরিয়াস’ নামটি ত্যাগ করেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল এই নামটি দেবদেবীর নামের সঙ্গে মিলে যায়।
দশম শতকে, পিটার ক্যানিপানোভা নামের একজন পোপ, দ্বিতীয় পিটার (Peter II) হওয়ার সম্ভাবনা এড়াতে জন চতুর্দশ (John XIV) নাম গ্রহণ করেন। এরপর থেকে, বিভিন্ন দেশের পোপেরা নিজেদের পূর্বসূরীদের অনুকরণে ইতালীয় নামের দিকে ঝুঁকেছেন।
এই ধারা আজও বহাল রয়েছে। ষোড়শ শতকে দ্বিতীয় মার্সেলুস (Marcellus II) এবং ষষ্ঠ আড্রিয়ান (Adrian VI)-এর মতো হাতে গোনা কয়েকজন পোপ তাঁদের দীক্ষার সময়ে পাওয়া নামই ব্যবহার করেছেন।
একটি নির্দিষ্ট নাম বেছে নেওয়ার কারণ।
প্রতিটি নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজস্ব ইতিহাস এবং তাৎপর্য। আগের পোপদের কীর্তি অথবা ব্যর্থতা, অথবা কোনো সাধু ব্যক্তির অবদান – এসবের ওপর ভিত্তি করে নামের নির্বাচন করা হয়।
সাধারণত, আগের পোপদের মধ্যে যাঁরা সংকটকালে চার্চকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সংস্কারের সূচনা করেছেন, অথবা জনপ্রিয় ছিলেন, তাঁদের নামের প্রতি সম্মান জানিয়ে নতুন পোপেরা নাম গ্রহণ করেন।
উদাহরণস্বরূপ, পোপ ফ্রান্সিস (Pope Francis) তাঁর নামের মাধ্যমে সেন্ট ফ্রান্সিস অফ অ্যাসিজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সেন্ট ফ্রান্সিসের শান্তি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি এবং চার্চের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সহযোগিতা—এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল তাঁর এই নামের মাধ্যমে।
তাঁর পূর্বসূরি পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট (Pope Benedict XVI) শান্তি ও সমঝোতার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে সেন্ট বেনেডিক্ট এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দায়িত্ব পালন করা পোপ পঞ্চদশ বেনেডিক্টের প্রতি সম্মান জানিয়েছিলেন।
কোনো নাম কি নিষিদ্ধ?
নতুন পোপ সম্ভবত প্রথম পোপ সেন্ট পিটার-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ‘পিটার’ নামটি ব্যবহার করবেন না। কারণ, বহু বছর ধরে প্রচলিত একটি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, দ্বিতীয় পিটার (Peter II) হবেন শেষ পোপ।
কিছু নাম আছে, যা সরাসরি নিষিদ্ধ না হলেও, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবহারের সম্ভাবনা কম। উদাহরণস্বরূপ, ‘আর্বান’ নামটি নতুন পোপের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।
কারণ, এই নামটি অষ্টম আর্বানকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি গ্যালিলিও গ্যালিলির বিচার শুরু করেছিলেন। বিজ্ঞান, বিশ্বাস ও ধর্মের আধুনিক বিতর্কের সঙ্গে এই নামের সম্পর্ক ভালো নাও হতে পারে।
একইভাবে, দ্বাদশ পায়াসের (Pius XII) নামও এড়ানো হতে পারে, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
ভবিষ্যতের পোপের সম্ভাব্য নাম।
যদি নতুন পোপ সংস্কারের পথে অবিচল থাকতে চান, তাহলে ত্রয়োদশ লিও-এর (Leo XIII) মতো নাম বেছে নিতে পারেন। ত্রয়োদশ লিও সামাজিক ন্যায়বিচার, ন্যায্য মজুরি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য পরিচিত ছিলেন।
অথবা, ত্রয়োদশ ইনোসেন্ট-এর (Innocent XIII) মতো নামও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে, যিনি দুর্নীতি নির্মূল করতে চেয়েছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের মতো যদি কোনো নতুন পোপ বিশ্ব থেকে নির্বাচিত হন, তবে তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের পোপদের ব্যবহৃত নাম, যেমন – গেলাসিয়াস, মিলতিয়াডস অথবা ভিক্টর গ্রহণ করতে পারেন।
ইতিহাসে, ৪৪ জন পোপ একবারের বেশি কোনো নাম ব্যবহার করেননি। পোপ ফ্রান্সিসও তাঁর ব্যতিক্রমী নামের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।
তাঁর এই সিদ্ধান্তটি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর আগে প্রায় ১,১০০ বছর পর্যন্ত ল্যান্ডো (Lando) নামের কোনো পোপ নির্বাচিত হননি, যিনি দশম শতকে স্বল্প সময়ের জন্য পোপ ছিলেন।
জন (John) নামটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, ২১ জন পোপ এই নামটি গ্রহণ করেছেন। তবে, বিভ্রান্তিকরভাবে, জন ত্রয়োদশ (John XXIII) ছিলেন এই নামের সর্বশেষ পোপ।
এরপর গ্রেগরি (Gregory) এবং বেনেডিক্ট (Benedict) নামগুলি যথাক্রমে ১৬ এবং ১৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে। ইনোসেন্ট (Innocent) এবং লিও (Leo) নামগুলিও ১৩ বার ব্যবহৃত হয়েছে।
বেনেডিক্ট দশমকে (Benedict X) অবৈধ পোপ ঘোষণা করে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, তাই পরবর্তী বেনেডিক্টদের সংখ্যায় এই গরমিল দেখা যায়।
নতুন পোপের নাম ঘোষণা।
সিস্টিন চ্যাপেল (Sistine Chapel)-এর চিমনির (chimney) ওপর যখন সাদা ধোঁয়া উড়তে থাকে এবং সেন্ট পিটার্স গির্জার ঘণ্টা বাজে, তখন নতুন পোপের নাম ঘোষণা করা হয়।
এই ঘোষণাটি ল্যাটিন ভাষায় করা হয়।
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার (St. Peter’s Basilica) কেন্দ্রীয় বারান্দায় একজন সিনিয়র কার্ডিনাল ডিকন (senior cardinal deacon) দুইজন পুরোহিতের সঙ্গে এসে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি করেন: “Habemus Papam” (“আমরা একজন পোপ পেয়েছি”)।
নতুন পোপের নাম, তাঁর দীক্ষার সময় পাওয়া নামের সঙ্গে, ল্যাটিন ভাষায় ঘোষণা করা হয়। তবে তাঁর পারিবারিক পদবি (surname) তাঁর মাতৃভাষায় অপরিবর্তিত থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস নির্বাচিত হওয়ার পর, তাঁর নাম “জর্জ মারিও” (Jorge Mario)-কে “জর্জিও মারিয়াম” (Giorgio Marium) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তবে তাঁর পদবি “বার্গোগলিও” (Bergoglio) অপরিবর্তিত ছিল।
তাঁর পোপীয় নাম “ফ্রান্সিসকাম” (Franciscum) ছিল এই ঘোষণার শেষ শব্দ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)