পোপের পালাবদল: শব্দকোষে লুকিয়ে আসল রহস্য!

পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া: কিছু জরুরি কথা ও রীতি-নীতি।

বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি একটি জটিল বিষয়। কোনো পোপের মৃত্যু অথবা পদত্যাগের পর নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা কিছু বিশেষ রীতি-নীতি অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন শব্দ এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে এই ধরনের খবর বুঝতে সুবিধা হয়।

পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কার্ডিনালদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্ডিনালরা মূলত পোপকে পরামর্শ দেন এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজে সহযোগিতা করেন। বর্তমানে বিশ্বে ২৬২ জন কার্ডিনাল রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩৫ জন ‘কার্ডিনাল ইলেকটর’ বা নির্বাচক হিসেবে পরিচিত, যাঁরা নতুন পোপ নির্বাচন করেন। তবে অসুস্থতার কারণে এবারের নির্বাচনে ১৩৩ জন কার্ডিনাল অংশ নিচ্ছেন। এই কার্ডিনালদের অধিকাংশই পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত।

‘কনক্লেভ’ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এটি একটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ ‘চাবি দিয়ে বন্ধ করা’। এই শব্দটির মাধ্যমে কার্ডিনালদের গোপন বৈঠকের স্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে তাঁরা নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য মিলিত হন। এই বৈঠকটি সিস্টিন চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত হয়। কোনো পোপের মৃত্যুর বা পদত্যাগের ২০ দিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। নির্বাচনের সময় বাইরের কারও সঙ্গে কার্ডিনালদের যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকে।

এই নির্বাচনের সময় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্থান জড়িত থাকে। যেমন, কার্ডিনালদের প্রধান বা ডিন অফ দ্য কলেজ অফ কার্ডিনালস-এর দায়িত্ব পালন করেন ইতালির কার্ডিনাল জিওভান্নি বাত্তিস্টা রে। তিনিই পোপের মৃত্যুর খবর কার্ডিনাল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জানান এবং কনক্লেভের আয়োজন করেন। যেহেতু তাঁর বয়স বেশি, তাই তিনি ভোট দিতে পারেন না। কনক্লেভ শুরুর পর সবচেয়ে বেশি বয়সী কার্ডিনাল হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন কার্ডিনাল পিয়েত্রো পারোলিন।

ভ্যাটিকান সিটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের অন্যতম প্রধান উপাসনাস্থল। এই বিশাল গির্জাটি ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং এখানে পোপদের সমাধিস্থলও রয়েছে। এই ব্যাসিলিকার অভ্যন্তরে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ‘পিয়েতা’ এবং জিয়ান লরেঞ্জো বার্নিনির ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল ক্যানোপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কনক্লেভের সময় কার্ডিনালদের থাকার জন্য নির্মিত বিশেষ স্থানটি হলো ‘ডোমুস সান্টা মার্তা’। সাধারণত এটি পর্যটকদের জন্য একটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কনক্লেভের সময় কার্ডিনালরা এখানে থাকেন। পোপ ফ্রান্সিস নির্বাচিত হওয়ার পরও এখানকার একটি কক্ষে বসবাস করতেন।

‘একস্ট্রা ওমনেস’ একটি লাতিন শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ ‘সবাই বাইরে যান’। এই কথাটি উচ্চারণ করেন পোপের বিশেষ অনুষ্ঠানের পরিচালক। এর মাধ্যমে সিস্টিন চ্যাপেল থেকে কার্ডিনাল ইলেকটর ছাড়া অন্য সকলকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়, যাতে ভোট গ্রহণ শুরু করা যায়।

নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর ‘হ্যাবেমাস প্যাপাম’ ঘোষণা করা হয়। এই লাতিন শব্দগুচ্ছের অর্থ হলো ‘আমরা একজন পোপ পেয়েছি’। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার বারান্দা থেকে কার্ডিনালদের একজন নতুন পোপের নাম ঘোষণা করেন।

ভোটের সময় অসুস্থ কার্ডিনালদের কাছ থেকে ব্যালট সংগ্রহ করার জন্য তিনজন কার্ডিনালকে নির্বাচন করা হয়, তাঁদের ‘ইনফার্মারি’ বলা হয়। ভোটের হিসাব পরীক্ষক হিসেবেও তিনজন কার্ডিনাল দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের বলা হয় ‘রিভাইজার’। এছাড়া, ব্যালট গণনা ও ফলাফল ঘোষণার দায়িত্বে থাকেন ‘ স্ক্রুটিনিয়ার’ নামক তিনজন কার্ডিনাল।

পোপের মৃত্যুর পর থেকে নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সময়কে ‘সিদে ভ্যাকানতে’ বলা হয়, যার অর্থ ‘শূন্য আসন’।

পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় ‘ইউনিভার্সি ডোমিনিচি গ্রেগিস’ নামক একটি নিয়মের মাধ্যমে। এই নিয়মটি সেন্ট জন পল দ্বিতীয়ের সময়ে প্রণীত হয়েছিল এবং পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট এর কিছু সংশোধন করেন।

সিস্টিন চ্যাপেলে ভোট গ্রহণের পর ব্যালটগুলো পোড়ানো হয়। যদি কোনো পোপ নির্বাচিত না হন, তবে ব্যালটের সঙ্গে কালো ধোঁয়া তৈরির জন্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। আর নতুন পোপ নির্বাচিত হলে সাদা ধোঁয়া তৈরি করা হয়, যা নতুন পোপ নির্বাচনের ঘোষণা হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত, এর পরেই গির্জার ঘণ্টা বাজানো হয়।

ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে নতুন পোপ নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনের দিকে সারা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে থাকে।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *