পোপের ঐতিহ্যবাহী ‘রবিবারীয় আশীর্বাদ’: ভ্যাটিকানের এক ঝলক।
ভ্যাটিকান সিটিতে বসবাসকারী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি অতি পরিচিত দৃশ্য হলো প্রতি রবিবার দুপুরের প্রার্থনা। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে সমবেত হাজারো মানুষের উদ্দেশ্যে পোপের এই বিশেষ আশীর্বাদ (আশীর্বাদ) প্রদানের রীতি চলে আসছে বহু বছর ধরে।
সম্প্রতি নির্বাচিত নতুন পোপ, লিও ১৪, এই পবিত্র কাজটি শুরু করতে যাচ্ছেন। আগামী রবিবার, সম্ভবত ইতালি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাদার্স ডে’ তে, তিনি তার প্রথম এই আশীর্বাদ দেবেন।
পোপের এই ‘রবিবারীয় আশীর্বাদ’-এর একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৫৪ সালে পোপ দ্বাদশ পিয়াস কুমারী মেরির প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি বিশেষ বছরের সূচনা করেন এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা পাঠ করা শুরু করেন।
প্রথমে তিনি রোমের বাইরে অবস্থিত গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ক্যাসেল গ্যান্ডলফো থেকে এই প্রার্থনা পাঠ করতেন। পরে, তিনি অ্যাপোস্টলিক প্যালেসের জানালা থেকে এই প্রার্থনা চালিয়ে যান, যা সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের দিকে মুখ করা।
এই প্যালেসটি ষোড়শ শতকে নির্মিত, যেখানে পোপের বাসভবন অবস্থিত। যদিও বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের একটি গেস্ট হাউসে বসবাস করেন, তবুও তিনি এই ঐতিহ্যটি অব্যাহত রেখেছেন।
এই আশীর্বাদ সাধারণ মানুষের কাছে পোপের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি করে। বিশেষ করে সেন্ট জন পল দ্বিতীয়ের (১৯৭৮-২০০৫) সময় থেকে পোপরা বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত বার্তা যোগ করেন।
যখন কোনো পোপ এই সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকেন, তখন তা বিশ্বজুড়ে সংবাদের শিরোনাম হয়। যেমন, পোপ ফ্রান্সিস অসুস্থতার কারণে চলতি বছরের শুরুতে এই প্রার্থনা করতে পারেননি।
এই প্রার্থনার সঙ্গে ‘এ্যাঞ্জেলুস’ (দেবদূত) নামক একটি বিশেষ প্রার্থনা জড়িত। এটি হলো কুমারী মেরির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা, যা অনেক ক্যাথলিক প্রতিদিন পাঠ করেন।
সাধারণত, এটি গণপ্রার্থনার আগে পাঠ করা হয়, তবে ঐতিহ্যগতভাবে এটি ভোর, দুপুর এবং সন্ধ্যায় ঘণ্টার ধ্বনির সঙ্গে পরিবেশিত হয়। এই প্রার্থনায় সেই মুহূর্তটির কথা উল্লেখ করা হয়, যখন প্রধান দেবদূত গ্যাব্রিয়েল মেরিকে বলেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের মা হতে যাচ্ছেন এবং মেরি তা গ্রহণ করেছিলেন।
‘এ্যাঞ্জেলুস’ শব্দটির অর্থ হলো ‘দেবদূত’। এই প্রার্থনার প্রথম স্তবকটি হলো, “প্রভুর দূত মেরি-কে বললেন।” এর উত্তরে ভক্তরা বলেন, “এবং তিনি পবিত্র আত্মায় গর্ভবতী হলেন।” এরপর একটি ‘Ave Maria’ (শুভ সংবাদ) এবং আরও কিছু স্তোত্র পাঠ করা হয়।
ক্যাথলিক ধর্মে এই ‘সুসংবাদ’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বহু শতাব্দী ধরে বিখ্যাত চিত্রকরদের ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মধ্যযুগে এই প্রার্থনা পাঠের রীতি শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
ইস্টার টাইমে (ইস্টার সানডে থেকে পেন্টেকস্ট পর্যন্ত ৫০ দিনব্যাপী সময়কাল) এই প্রার্থনার পরিবর্তে ‘রেজিনা কয়েলি’ (স্বর্গের রানী) পাঠ করা হয়, যা খ্রিস্টের পুনরুত্থানে আনন্দ প্রকাশ করে।
এই ‘রবিবারীয় আশীর্বাদ’-এর কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে। ২০০৫ সালে অসুস্থ অবস্থায় সেন্ট জন পল দ্বিতীয় তার শেষ ‘এ্যাঞ্জেলুস’ প্রার্থনার জন্য হাসপাতালের জানালা দিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে।
তিনি কোনো কথা বলেননি, কেবল জলপাই পাতার শাখা দিয়ে জনতাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। একজন আর্চবিশপ তখন তাঁর বার্তাটি পৌঁছে দেন।
২০১৩ সালে, পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তার পদত্যাগের আগে শেষ রবিবারীয় প্রার্থনা করেন। এর আগে ৬০০ বছরে কোনো পোপের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি।
ভক্তরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল এবং তিনি তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি চার্চ ত্যাগ করছেন না, বরং বার্ধক্যের কারণে প্রার্থনার দিকে মনোনিবেশ করছেন।
পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ সালে তার প্রথম ‘এ্যাঞ্জেলুস’-এ তার মূল বার্তা, “দয়া” (mercy) তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, “একটু দয়া এই পৃথিবীকে কম শীতল এবং আরও ন্যায়পূর্ণ করে তোলে।”
সম্প্রতি, তিনি এই আশীর্বাদগুলি ইউক্রেন এবং গাজায় শান্তির জন্য আহ্বান জানাতে ব্যবহার করেছেন। তিনি প্রায়শই তার আশীর্বাদ শেষ করেন এই সাধারণ কথাটি দিয়ে: “ভালো দুপুরের খাবার খান।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস