আলুর অজানা কাহিনী: এক সময়ের নিষিদ্ধ সবজি, যা আজ বিশ্বজুড়ে প্রিয়।
আমাদের খাদ্য তালিকায় আলু একটি অতি পরিচিত নাম। আলু ভাজা থেকে শুরু করে আলুর দম, আলুর চপ—এমন বহু পদে এর উপস্থিতি অনস্বীকার্য।
কিন্তু এই আলুর জন্মকথা, এর উত্থান-পতন এবং বিশ্বজুড়ে এর জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ, বিস্ময়কর ইতিহাস। আসুন, সেই গল্পটি শুনি।
আজকের এই আলু, যা আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি, তার আদি নিবাস কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশে নয়। প্রায় আট হাজার বছর আগে, দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায় ইনকা সভ্যতার মানুষজন প্রথম এর চাষ শুরু করে।
পুষ্টিগুণে ভরপুর, ঠান্ডা সহিষ্ণু এবং অনুর্বর মাটিতেও ফলনযোগ্য হওয়ায়, আলু দ্রুতই তাদের প্রধান খাদ্যে পরিণত হয়।
পনেরো শতকে স্প্যানিশরা আলু ইউরোপে নিয়ে আসে। কিন্তু শুরুতে এর কদর সেভাবে হয়নি।
লোকমুখে শোনা যেত, আলু নাকি “শয়তানের ফসল”, যা খেলে কুষ্ঠ রোগ হয়। এমনকি, এর থেকে তৈরি খাবার ‘অখ্রিষ্টান’ বলেও মনে করা হতো।
ফ্রান্সে তো একসময় আলু চাষ নিষিদ্ধই ছিল!
কিন্তু আঠারো শতকের শেষের দিকে ফ্রান্সে দেখা দেয় চরম খাদ্য সংকট। একদিকে খারাপ আবহাওয়া, অন্যদিকে দুর্বল চাষাবাদের কারণে গমের ফলন কমে যায়।
রুটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে এক ফরাসি ফার্মাসিস্ট, আঁতোয়ান-অগাস্টিন পারমেন্তিয়ের-এর হাত ধরে আলুর কপাল ফেরে।
তিনি প্রমাণ করেন, আলু মানুষের খাদ্য হিসেবে নিরাপদ। প্যারিসের অভিজাতদের কাছে আলুর পরিচিতি বাড়াতে তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেন—মারি আঁতোয়ানেতের উইগের জন্য আলুর ফুল ব্যবহার করা থেকে শুরু করে, রাজার পোশাকের জন্য আলুর বোতাম তৈরি করা—সবকিছুই ছিল এই প্রচারণার অংশ।
এমনকি তিনি রাজার পক্ষ থেকে প্যারিসের কাছে ৫৪ একর জমিতে আলু চাষ শুরু করেন এবং রাতে সেই জমি অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেন, যাতে সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়ে আলু চুরি করে এবং নিজেরাও এর চাষ শুরু করে।
ফ্রান্সে যখন আলুর কদর বাড়ছিল, তখন প্রতিবেশী দেশ প্রুশিয়ায় এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট।
তিনি কৃষকদের আলু চাষ করতে উৎসাহিত করেন। প্রথমে তারা রাজি না হলেও, পরে রাজার নির্দেশে আলু চাষ করতে বাধ্য হয়।
উনিশ শতকে আলু কেবল খাদ্য হিসেবেই নয়, বরং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। এরপর ধীরে ধীরে এটি আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, চীন এবং পেরুর মতো দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
বর্তমানে, আলুর জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন রান্নার সংস্কৃতিতে এটি মিশে গেছে—ভারতীয় আলুর দম থেকে কোরিয়ান গামজা জোরিম—আলু সবখানেই তার জায়গা করে নিয়েছে।
তবে আধুনিক বিশ্বে আলুর ধারণা কিছুটা বদলেছে। প্রক্রিয়াজাত খাবার হিসেবে এর ব্যবহার বাড়ায় অনেকে একে স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে চান।
কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, আলু এখনো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান।
আলু, যা একসময় ছিল উপেক্ষিত, আজ খাদ্য হিসেবে কোটি মানুষের জীবনে অপরিহার্য। তাই, আলু শুধু একটি সবজি নয়, এটি পরিবর্তনের গল্প, টিকে থাকার গল্প।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক