প্রেমের ঘোর: কিভাবে ভালোবাসার আবেশে মানুষ বিভোর হয়?

প্রেম যখন তীব্র উন্মাদনায় পরিণত হয়: ‘লাইমেরেন্স’-এর মনোবিজ্ঞান।

ভালোবাসা, যা মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, অনেক সময় এক বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। এই অবস্থাটি হল ‘লাইমেরেন্স’ (Limerence)।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি তীব্র আকর্ষণ, মোহ এবং ভালোবাসার এক জটিল মিশ্রণ। সম্প্রতি, লাইমেরেন্স নিয়ে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে এর মনোবৈজ্ঞানিক দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

লাইমেরেন্স আসলে কী?

লাইমেরেন্স হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্য একজনের প্রতি তীব্র আবেগ অনুভব করেন। এটি নিছক আকর্ষণ বা ভালো লাগার চেয়ে অনেক গভীর।

এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হল:

  • অন্য ব্যক্তির প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণ।
  • তাঁর সম্পর্কে অবিরাম চিন্তা।
  • তাঁর সান্নিধ্য লাভের তীব্র বাসনা।
  • তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়।
  • মেজাজের চরম পরিবর্তন।

এই অনুভূতিগুলো ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে, এটি আসক্তির মতো রূপ নিতে পারে।

লাইমেরেন্স-এর কারণ ও মস্তিষ্কের ভূমিকা

লাইমেরেন্স-এর মূল কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে বিজ্ঞানীরা এর পেছনে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক ক্রিয়াকে দায়ী করেন।

ভালোবাসার প্রাথমিক পর্যায়ে, মস্তিষ্কের আনন্দ কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা ডোপামিন (Dopamine) সহ কিছু নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) নিঃসরণ করে। এর ফলে তীব্র ভালো লাগা, উত্তেজনা এবং আনন্দ অনুভব হয়।

যদি এই অনুভূতিগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বজায় থাকে এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তবে তা লাইমেরেন্সের দিকে মোড় নিতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ‘অ্যাংজাইটি অ্যাটাচমেন্ট স্টাইল’ (Anxious attachment style) সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে লাইমেরেন্স-এর প্রবণতা বেশি।

অর্থাৎ, যারা সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগে ভোগেন, তাঁদের মধ্যে এই ধরনের মানসিক অবস্থা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

লাইমেরেন্স-এর অভিজ্ঞতা: একটি ব্যক্তিগত গল্প

অধ্যাপক টম বেলামি (Dr. Tom Bellamy), যিনি নিজেও লাইমেরেন্স-এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, লাইমেরেন্স-এর সঙ্গে লড়াই করা কঠিন হলেও, তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এবং উত্তরণের উপায়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, প্রথমে নিজের অনুভূতিগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

এরপর, লাইমেরেন্স-এর কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং ধীরে ধীরে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। তিনি তাঁর ‘স্মিটেন’ (Smitten) নামক বইয়ে এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

লাইমেরেন্স-এর বিস্তার ও প্রভাব

গবেষণায় দেখা গেছে, জনসংখ্যার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় লাইমেরেন্স-এর অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের জীবনে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

এটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

উত্তরণের উপায়

লাইমেরেন্স থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে।

  • নিজের অনুভূতিগুলো চিহ্নিত করা ও বোঝা।
  • অন্য ব্যক্তির থেকে দূরত্ব বজায় রাখা।
  • নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • মনোবিদের সাহায্য নেওয়া।
  • নতুন শখ বা কাজে মনোনিবেশ করা।

লাইমেরেন্স একটি জটিল মানসিক অবস্থা, তবে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা গ্রহণ করা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য সূত্র: টম বেলামি-র ‘স্মিটেন’ (Smitten) এবং livingwithlimerence.com ওয়েবসাইট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *