মরুভূমির আগ্রাসনে বিলুপ্তির পথে আফ্রিকার এক প্রাচীন জনপদ।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার একটি প্রাচীন জনপদ, ওউয়ালাতা। সাহারা মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত এই জনপদটি একসময় ছিল বাণিজ্য এবং ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে এখানকার পুরনো বাড়িগুলো, যা মাটির ইট (banco) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই বাড়িগুলোর কারুকার্য ও স্থানীয় নারীদের আঁকা নকশা ওউয়ালাতাকে দিয়েছে এক বিশেষ পরিচিতি।
ওউয়ালাতা শুধু তার স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এর সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অমূল্য নিদর্শন এখানকার পরিবারগুলোর সংগ্রহে থাকা শত শত বছরের পুরনো পান্ডুলিপিগুলোর জন্য আজও স্মরণীয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পাণ্ডুলিপিগুলো এখানকার মানুষের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।
এখানকার ইমাম, মোহাম্মদ বেন বাতি, কোরআনিক পণ্ডিতদের বংশধর। তাঁর পারিবারিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে ২২৩টি পান্ডুলিপি, যার মধ্যে ১৪ শতকের হাতে লেখা পুঁথিও রয়েছে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে ওউয়ালাতা আজ টিকে থাকার লড়াই করছে। মরুকরণের কারণে এখানকার পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে। তীব্র গরম আর মাঝে মাঝে হওয়া বৃষ্টি এখানকার ঐতিহাসিক বাড়িগুলোর জন্য হুমকি স্বরূপ।
“বৃষ্টির কারণে অনেক ঘর ভেঙে গেছে,” – বলছিলেন খাদী, যিনি তাঁর দাদার বাড়িটি দেখাশোনা করেন।
জনসংখ্যা কমে যাওয়াও ওউয়ালাতার জন্য একটি বড় সমস্যা। কাজের সন্ধানে মানুষজন শহর ছেড়ে যাওয়ায় পুরনো বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হচ্ছে।
“বাড়ির মালিকরা অন্যত্র চলে যাওয়ায় ঘরগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,” – জানালেন সিদিয়া, যিনি দেশটির প্রাচীন শহরগুলো সংরক্ষণে নিয়োজিত একটি জাতীয় ফাউন্ডেশনের সদস্য।
ওউয়ালাতার পুরনো শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়িতে এখন মানুষের বসবাস। এখানকার পরিবেশ এতটাই শুষ্ক যে একসময় মসজিদের উপরেও বালু জমে গিয়েছিল, ফলে মানুষ মসজিদের ভেতরে নামাজ পড়তে না পেরে মসজিদের উপরে নামাজ পড়ত।
ওউয়ালাতাকে টিকিয়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকে স্পেন এখানে একটি লাইব্রেরি তৈরিতে অর্থ সাহায্য করেছিল, যেখানে দুই হাজারের বেশি বই পুনরুদ্ধার ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
তবে এই ঐতিহ্য রক্ষার কাজটি বর্তমানে কিছু মানুষের নিরলস প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল। ইমাম বেন বাতির মতে, “লাইব্রেরিটির সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, কারণ এখানে ভাষা, কোরআনের জ্ঞান, ইতিহাস, এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান তথ্য সংরক্ষিত আছে।”
পর্যটকদের জন্য ওউয়ালাতা এখনো সহজলভ্য নয়। এখানে কোনো হোটেল নেই এবং নিকটতম শহরটি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা দূরে অবস্থিত। বিদ্রোহীদের উপদ্রবের কারণে অনেক দেশ এই অঞ্চলে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেয়।
ওউয়ালাতাকে রক্ষার জন্য গাছ লাগানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে সিদিয়া স্বীকার করেন, এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়।
বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত এই শহরের ঐতিহ্য রক্ষায় প্রতি বছর একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা পুনরুদ্ধার ও বিনিয়োগের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে এবং মানুষকে এখানে থাকতে উৎসাহিত করে।
সূর্যাস্তের সময় যখন ধাহার পর্বতমালার পিছনে আলো মিলিয়ে যায়, তখন ওউয়ালাতার শিশুরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে, যা এই প্রাচীন জনপদে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা