যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে একটি নতুন বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে – সম্পত্তি কর সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া যায় কিনা। দেশটির কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ধনী ব্যক্তি এই ধারণার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, যেখানে তাঁদের প্রধান যুক্তি হলো, বাড়ি-ঘরের মালিকদের ওপর চাপানো এই কর কার্যত সরকারের কাছে “ভাড়া দেওয়ার” মতো।
তবে এর বিপক্ষে থাকা ব্যক্তিদের আশঙ্কা, এমনটা হলে স্থানীয় সরকারগুলোর তহবিল কমে যাবে, যা স্কুল, রাস্তাঘাট এবং জরুরি পরিষেবাগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করবে।
এই বিতর্কের মূলে রয়েছে দেশটির ক্রমবর্ধমান আবাসন মূল্য এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচ। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মার্জোরি টেইলর গ্রিন এই করকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন।
প্রযুক্তি বিলিয়নেয়ার ইলন মাস্কও এই করের বিরোধিতা করে একে সরকারের “প্রকৃত ইজারা” হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন।
ফ্লোরিডার গভর্নর ও সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রন ডিসান্তিসও তাঁর রাজ্যে এই কর কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যদি আপনি আপনার বাড়ির মালিক হন, তাহলে সরকারের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে এর মালিক হওয়া উচিত।”
যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সরকারগুলো তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে সম্পত্তি করের মাধ্যমে। এই কর থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে স্কুল, পার্ক, রাস্তা, পুলিশ ও দমকল বিভাগ, এমনকি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করা হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় করের পরিমাণও বেড়েছে, যা অনেক মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড শ্লাইচারের মতে, এটি একটি “সম্পত্তি কর বিদ্রোহ”, যা শহর ও রাজ্যগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
বিভিন্ন রাজ্যে এরই মধ্যে এই নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত বছর নয়টি রাজ্যে ভোটাররা এই কর কমানো বা সীমাবদ্ধ করার পক্ষে রায় দিয়েছেন।
টেক্সাস, ইন্ডিয়ানা, নিউ জার্সি এবং নিউইয়র্কের মতো রাজ্যগুলোতেও সম্পত্তি করের বোঝা কমাতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তবে অনেকে মনে করেন, এই ধরনের পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। মিশিগান ও ওহাইওর মতো রাজ্যগুলোতে এখন এমন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যেখানে সরাসরি সম্পত্তি কর সম্পূর্ণভাবে বাতিলের জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হচ্ছে।
টেক্সাসের রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ব্রায়ান হ্যারিসন ২০৩১ সালের মধ্যে এই কর সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করার জন্য একটি সাংবিধানিক সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। হ্যারিসনের মতে, “নিয়মিত সম্পত্তি কর দেওয়াটা অনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের পরিপন্থী।”
তবে সম্পত্তি কর বাতিলের ফলে স্থানীয় সরকারগুলোর বাজেট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। একটি অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ট্যাক্স ফাউন্ডেশন এর মতে, জাতীয়ভাবে স্থানীয় সরকারগুলোর আয়ের ৭০ শতাংশ আসে এই কর থেকে।
শুধু ফ্লোরিডাতেই গত বছর প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা) সম্পত্তি কর হিসেবে আদায় হয়েছে।
ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যারেড ওয়ালজ্যাকের মতে, সম্পত্তি কর নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়লেও, এটি বাতিল করা হলে অনেক স্থানীয় সরকার তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে না।
তাঁর মতে, গ্রামীণ ও আবাসিক এলাকাগুলোতে বিক্রয় করের মতো আয়ের উৎস কম থাকে। ফলে রাজ্যগুলোকে নতুন করের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, যা স্থানীয় কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমিয়ে দেবে।
অন্যদিকে, ফ্লোরিডার গভর্নর ডিসান্তিসও স্বীকার করেছেন, পর্যটন থেকে পাওয়া কর এবং দ্বিতীয় বাড়ির ওপর ধার্য করা করের কারণে ফ্লোরিডা সম্ভবত এই পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে তিনি এখনো বিস্তারিত কোনো পরিকল্পনা জানাননি।
এই বিতর্কের সঙ্গে পুরোনো একটি ঘটনার মিল পাওয়া যায়। পঞ্চাশ বছর আগে, যখন বাড়ির দাম বেড়ে গিয়েছিল, তখন করের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার “প্রপোজিশন ১৩”-এর মতো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যা সম্পত্তি করের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।
তবে এই আন্দোলন শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। কিছু রক্ষণশীল সংগঠন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, “ক্লাব ফর গ্রোথ” নামের একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী, যারা ধনী রিপাবলিকানদের কাছ থেকে অর্থ পায়, তারা এই ইস্যুতে আইনপ্রণেতা ও গভর্নর প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করছে।
তবে এই আন্দোলনের একটি বড় ধাক্কা লাগে নর্থ ডাকোটা রাজ্যে। সেখানে গত বছর একটি গণভোটের মাধ্যমে সম্পত্তি কর বাতিলের প্রস্তাব পরাজিত হয়।
ডেমোক্রেটদের একটি দল এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল।
এই বিতর্কের প্রভাব ভবিষ্যতে কেমন হবে, তা এখনো বলা কঠিন। তবে এটি স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সম্পত্তি কর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এর পরিবর্তন দেশের স্থানীয় সরকার ও নাগরিকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন