প্রতিদিনের দয়া: ছোট্ট কাজটি কীভাবে বদলে দিল এক নারীর জীবন?

দয়া প্রদর্শনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত: প্রতিদিন একটি ভালো কাজ, আর তা থেকে এক নারীর জীবনের মোড় পরিবর্তন।

আজ আমরা এমন এক নারীর গল্প শোনাবো, যিনি প্রায় ১৪ বছর আগে, সমাজের প্রতি এক গভীর দায়িত্ববোধ থেকে প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বার্নাডেট রাসেল নামের এই নারী, ২০১১ সালের ১৮ই আগস্ট তারিখে একটি সাধারণ ঘটনার সাক্ষী হন, যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন পথে চালিত করে।

সে সময়, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর আসছিল। রাস্তাঘাটে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ছবিগুলো বার্নাডেটের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একদিন, তিনি লন্ডনের একটি পোস্ট অফিসে যান। সেখানে, এক তরুণকে দেখেন যিনি সম্ভবত ওই দাঙ্গার ছবিগুলোর মতোই পোশাক পরেছিলেন। বার্নাডেট মনে মনে ভেবেছিলেন, হয়তো এই তরুণকে সমাজের চোখে খারাপভাবে দেখা হচ্ছে।

হয়তো সে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এরপর তিনি শুনলেন, স্ট্যাম্প কেনার মতো তার কাছে যথেষ্ট টাকা নেই।

বার্নাডেট সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে সেই তরুণের স্ট্যাম্পের দাম পরিশোধ করে দেন। তার এই সামান্য কাজটিই ছিল বার্নাডেটের জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। তরুণটি তাকে কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়েছিল।

বার্নাডেটের ভাষায়, সেই ধন্যবাদগুলো ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, একইসাথে কিছুটা বেদনারও।

এরপর বার্নাডেট অনুভব করলেন, সমাজের খারাপ খবরগুলো তাকে হতাশ করে দেয়, যেন তিনি অসহায়। কিন্তু সেদিন পোস্ট অফিস থেকে ফেরার পথে, তিনি এক নতুন শক্তি অনুভব করলেন।

তিনি বুঝতে পারলেন, কিভাবে সামান্য দয়াও মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করবেন।

এই ভালো কাজগুলো সবসময় বড় আকারের ছিল না। কখনো তিনি রাস্তায় পথ ভুল করা পর্যটকদের সাহায্য করেছেন, আবার কখনো বৃদ্ধ কোনো ব্যক্তিকে ব্যাগ বহন করতে সহায়তা করেছেন।

একবার তিনি চেষ্টা করেছিলেন, ট্রেনের স্টেশনে এক অপরিচিত ব্যক্তিকে একটি কার্ড দিতে, কিন্তু সেই ব্যক্তি সেটি নিতে রাজি হননি। তবে, বার্নাডেট এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছিলেন, ‘দয়া’র ধারণা একেক জনের কাছে একেক রকম হতে পারে।

বার্নাডেটের করা একটি প্রিয় কাজ ছিল, তার এক বন্ধুর দাদার জন্য একটি উকুলেলে ক্লাস নেওয়া। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাদ্যযন্ত্রটি বাজাননি। বার্নাডেট তাকে আবার বাজানো শেখান।

এরপর তারা একসঙ্গে উকুলেলে বাজিয়েছিলেন।

বার্নাডেট লক্ষ্য করেছেন, তিনি যত বেশি মানুষের প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন, তত বেশি মানুষও অন্যদের প্রতি দয়া দেখাচ্ছে। তিনি যেন ‘দয়া’ নামক এক ফিল্টার দিয়ে জগৎটাকে দেখতে শুরু করেছিলেন।

তিনি খেয়াল করতেন, কিভাবে মানুষজন অন্যের জন্য তাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছে।

এই ঘটনার অন্য একটি দিকও ছিল। বার্নাডেট বুঝতে পারছিলেন, তিনি নিজেও কতবার অন্যদের কাছ থেকে দয়া পেয়েছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

তিনি এখন আর খবর দেখলে আগের মতো হতাশ হন না। খারাপ দিনেও তিনি নিজেকে মনে করিয়ে দেন, চারপাশে প্রতিনিয়ত কত ভালো কাজ হচ্ছে।

বার্নাডেটের দৃঢ় বিশ্বাস, দয়া বিশ্বকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। তিনি মনে করেন, যদি প্রতিটি কাজ ও চিন্তার মূলে দয়া থাকে, তবে তা সত্যিই বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে।

বার্নাডেটের মতে, দয়া মানে শুধু ছোটখাটো উপহার দেওয়া নয়। এর একটি দৃঢ়, শক্তিশালী দিকও রয়েছে। এটি সমাজের ভুল ধারণার বিরুদ্ধে কথা বলা, এবং সহানুভূতি ও শান্তির পথে কাজ করার বিষয়।

বর্তমানে, বার্নাডেট একজন লেখক, যিনি ‘Conversations on Kindness’ নামে একটি বই লিখেছেন। যেখানে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন এবং অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন ধারণাকেও তুলে ধরেছেন।

বার্নাডেটের এই যাত্রা আমাদের সবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। ছোট ছোট দয়া, সামান্য ভালো কাজ—এগুলো আমাদের জীবনকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *