মার্কিন মুলুকে রামaphosa: ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক কি শুধরানো সম্ভব?

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের যুক্তরাষ্ট্র সফর: দুই দেশের সম্পর্ক কিu09f0 সহজ হবে?

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসা আগামী সোমবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন। এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের শীতল সম্পর্ককে ‘নতুন মোড়’ দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট রামাপোসার এই সফর এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ৫৯ জন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। ট্রাম্পের দাবি, দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের ওপর ‘জাতিগত’ নিপীড়ন চালানো হচ্ছে এবং তারা ‘গণহত্যার’ শিকার হচ্ছেন। বিশেষ পুনর্বাসন পরিকল্পনার অধীনে তারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এবং সেখানে তাদের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের মতে, শ্বেতাঙ্গরা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ হলেও, তাদের হাতে এখনো দেশটির ৭০ শতাংশের বেশি ভূমি রয়েছে এবং তাদের প্রতি কোনো বৈষম্য করা হয় না।

রামাপোসার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, দুই দেশের শীর্ষ নেতারা দ্বিপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। তবে হোয়াইট হাউস এখন পর্যন্ত বৈঠকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

জানুয়ারি মাসে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর এই প্রথম কোনো আফ্রিকান নেতাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এছাড়া, বর্তমানে জি-২০ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে দক্ষিণ আফ্রিকা। নভেম্বরে তারা এই দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করবে।

এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের সম্ভাব্য সময়সূচী এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী প্রধান বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

  • রামাপোসা আগামী ১৯ মে সোমবার যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা করবেন এবং ২১ মে বুধবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
  • বৈঠকের আলোচ্যসূচি এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে, এই সফর দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন করে সাজানোর সুযোগ করে দেবে।
  • বৈঠকে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের প্রতি আচরণ, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তা হ্রাস এবং ইউক্রেন ও গাজায় চলমান যুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের সঙ্গে রামাপোসার নেতৃত্বাধীন সরকারের সম্পর্ক উভয় দেশের মধ্যে উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ। শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানরা মূলত ডাচ colonisers-দের বংশধর, যারা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বর্ণবৈষম্য নীতি ‘অ্যাপার্টহাইড’-এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে শাসন করেছে। বর্তমানেও দেশটির অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং খামারের মালিক শ্বেতাঙ্গ। দেশটির অর্ধেকের বেশি কৃষ্ণাঙ্গ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

ট্রাম্প এবং তাঁর সহযোগী, দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া বিলিয়নেয়ার ইলন মাস্ক রামাপোসা সরকারের সমালোচনা করেছেন। তারা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে খারাপ আচরণের অভিযোগ তুলেছেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, প্রেসিডেন্ট রামাপোসার একটি ভূমি অধিগ্রহণ বিল (Expropriation Bill) স্বাক্ষর করা, যা সরকারকে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কিছু ক্ষেত্রে ভূমি দখলের অনুমতি দেয়।

এই আইনের মাধ্যমে, ভূমিহীন নারী ও প্রতিবন্ধীদের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জমি বিতরণের সুযোগ তৈরি হবে। কিছু আফ্রিকানারের মতে, এই আইনের কারণে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হতে পারে।

ট্রাম্প শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের একটি দলের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যারা আশঙ্কা করছেন যে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হবে। তারা আরও বলছেন, শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন এবং এটি গণহত্যার শামিল।

তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, এসব ঘটনা সাধারণ অপরাধের অংশ। গত ১৩ মে আইভরি কোস্টের আবিজানে আফ্রিকা সিইও ফোরামে দেওয়া ভাষণে রামাপোসা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ভুল ধারণা পোষণ করছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সব বর্ণের মানুষই উচ্চ মাত্রার সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকরাই সশস্ত্র অপরাধীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন।

এদিকে, ইন্টারনেট কোম্পানি স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা মাস্কও দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা শুরু করতে না পারার জন্য সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতায়ন আইন (Black empowerment laws) -এর কারণে তিনি সেখানে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না, যেখানে সরকারি চুক্তি পেতে হলে বড় কোম্পানিগুলোকে কৃষ্ণাঙ্গদের মালিকানা রাখতে হয়। মাস্কের দাবি, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ না হওয়ায় স্টারলিংক চালু করার অনুমতি পাননি। সরকারি কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, দেশটির ব্যবসায়িক আইন ঐতিহাসিক ভুলগুলো শুধরানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক আঘাত এসেছে। প্রথমে, ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বিদেশি সহায়তা স্থগিত করার নির্দেশ দেন, যার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে, এইচআইভি-এর মতো মারাত্মক রোগের চিকিৎসা ও গবেষণায়ও ব্যাঘাত ঘটে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এইচআইভি-তে আক্রান্ত এবং দেশটির সরকার এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রায় ১৮ শতাংশ সহায়তা পেয়ে থাকে।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ‘জাতিগত বৈষম্য’-এর অভিযোগ এনে দেশটির জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা বন্ধের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে তিনি গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) দক্ষিণ আফ্রিকার আনা মামলারও সমালোচনা করেন।

সবশেষে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এপ্রিলে দেশটির সব পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় তৈরি হওয়া গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে, যা গাড়ির ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশ।

রামাপোসা ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘শাস্তিমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, এই শুল্ক বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

যদিও ট্রাম্প ৯ এপ্রিল ৯০ দিনের জন্য অনেক দেশের (দক্ষিণ আফ্রিকা সহ) ওপর শুল্ক স্থগিত করেছিলেন, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার চায় এই শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা হোক। এছাড়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এখনো ট্রাম্পের আরোপ করা ১০ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে চীনের পরেই দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০০০ সালে চালু হওয়া ‘আফ্রিকা গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট’-এর (AGOA) অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রকে মূল্যবান পাথর, ইস্পাত ও গাড়ি বিক্রি করে এবং এর বিনিময়ে অপরিশোধিত তেল, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও বিমান আমদানি করে।

এই AGOA চুক্তির মেয়াদ এ বছর শেষ হচ্ছে এবং ট্রাম্প প্রশাসন এটি অব্যাহত রাখবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা গত ২৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) মামলা দায়ের করে। ইসরায়েলের মিত্র ও প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি ছিল অপ্রত্যাশিত।

এই মামলার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার জোরালো সমর্থন প্রকাশ পায়। জানুয়ারিতে এই মামলার শুনানি শুরু হয় এবং মার্চে আদালত ইসরায়েলকে গাজায় খাদ্য সহায়তা সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং রাফায় আক্রমণ বন্ধ করতে জরুরি নির্দেশ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের আগের ও বর্তমান উভয় সরকারই দক্ষিণ আফ্রিকার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। ট্রাম্প এটিকে ‘আগ্রাসী’ বলেও মন্তব্য করেছেন।

অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকা এই মামলার বিষয়ে অনড় থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের কারণে কিছু প্রতিকূলতা আসলেও, তারা তাদের নীতিতে অবিচল থাকবেন।

এছাড়া, বৈঠকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এই বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *