যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা গবেষণা খাতে অর্থায়ন কমানোর ফলে স্বাস্থ্যখাতে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমেরিকান মেডিকেল কলেজগুলোর এক নতুন প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে, যা চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং রোগীদের জন্য উদ্বেগের কারণ।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা গবেষণা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেডারেল সরকারের গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা বিজ্ঞান এক অস্তিত্বের সংকটের দিকে যাচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা এবং রোগীর সেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
প্রস্তাবিত কর এবং ব্যয়ের কাটছাঁটের ফলে, দেশটির প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ স্বাস্থ্য বীমা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। একইসঙ্গে, চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল কলেজ এবং শিক্ষাদানকারী হাসপাতালগুলো একত্রিত হয়ে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ আমেরিকান মেডিকেল কলেজস’ (এএএমসি) নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গবেষণা, শিক্ষা এবং রোগীর যত্ন—চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই তিনটি স্তম্ভই বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন।
এই প্রথম এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে এই তিনটি বিষয় একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এএএমসি’র বিজ্ঞান নীতি বিষয়ক সিনিয়র পরিচালক হিদার পিয়ার্স এক সাক্ষাৎকারে জানান, যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক সংকট দেখা দেবে। এছাড়াও, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি কমে যাবে এবং স্বাস্থ্যসেবার মানও হ্রাস পাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একাডেমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যেখানে মেডিকেল স্কুল ও শিক্ষাদানকারী হাসপাতালগুলো অন্তর্ভুক্ত, তারা ভবিষ্যতের চিকিৎসক তৈরি করে এবং জটিল রোগের চিকিৎসা করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রমা সেন্টার, অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, প্রসূতি বিভাগ এবং মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি সক্রিয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষাদানকারী হাসপাতালগুলোতে, যেখানে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যকর্মীরা হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পান, সেখানে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অন্যান্য হাসপাতালের রোগীদের চেয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (এনআইএইচ)-এর অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাগুলোতেও এই কাটছাঁটের প্রভাব পড়ছে। ইতিমধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকে ১,১০০-এর বেশি এনআইএইচ গবেষণা প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে এইচআইভি/এইডস, ক্যান্সার, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদকাসক্তি বিষয়ক অন্তত ১৬০টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষা (রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য পরীক্ষামূলক প্রয়োগ)।
হিদার পিয়ার্স উল্লেখ করেন, অনেক রোগের ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোতে যাদের সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাদের জন্য এই ট্রায়ালগুলোই একমাত্র ভরসা হতে পারে।
কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হলে, তা অনৈতিক এবং গবেষণার ফলাফলকে কম কার্যকর করে তোলে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গবেষণা খাতে অর্থায়নের ফলে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এনআইএইচ-এর অর্থায়নে ১৯৬০ সালে প্রথম কৃত্রিম হার্ট ভালভ তৈরি করা হয় এবং এর সফল প্রতিস্থাপনও করা হয়।
বর্তমানে প্রতি বছর ১ লক্ষেরও বেশি হার্ট ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়াও, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে অনুমোদন পাওয়া নতুন ঔষধগুলোর গবেষণায়ও এনআইএইচ-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক কলেজ ও শিক্ষাদানকারী হাসপাতালগুলো প্রতি বছর প্রায় ৭৭ হাজার রেসিডেন্ট চিকিৎসক তৈরি করে। ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্র সহায়তা কর্মসূচি বাতিল এবং ঋণের যোগ্যতা পরিবর্তনের প্রস্তাবের কারণে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এমনটা চলতে থাকলে, ২০৩৬ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৬ হাজার চিকিৎসকের ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হিদার পিয়ার্স আরও জানান, গবেষণা খাতে বিনিয়োগ কমে গেলে এবং অভিবাসন নীতি কঠোর হলে, বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আকর্ষণ কমতে শুরু করবে। কারণ, উন্নত বিশ্বের অনেক শিক্ষার্থী ও গবেষক ভালো সুযোগের অভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবনী সক্ষমতা মূলত ফেডারেল সরকারের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। এই সহযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়লে, উদ্ভাবন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
চিকিৎসা গবেষণায় অর্থায়ন কমানো হলে, রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করার মতো পরিবেশ তৈরি করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন