ভাত নিয়ে ১১টি অজানা তথ্য যা হয়তো আপনি জানেন না!

ধান: আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য সম্পর্কে ১১টি অজানা তথ্য

ভাত বাঙালির খাদ্যতালিকায় একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিনের খাদ্য থেকে শুরু করে উৎসব-অনুষ্ঠান—সবখানেই ভাতের উপস্থিতি অনিবার্য। গরম ভাতের সঙ্গে নানা পদের তরকারি বা মাছ-মাংসের যুগলবন্দী বাঙালির অতি পরিচিত একটি দৃশ্য।

কিন্তু এই অতি পরিচিত খাবারটি সম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি? আসুন, আজ জেনে নিই ভাতের কিছু অজানা এবং আকর্ষণীয় তথ্য।

প্রায় ৯,০০০ বছর ধরে মানুষ ধান চাষ করছে। চীনের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে জানা যায়, ১৩,৫০০ থেকে ৮,২০০ বছর আগে সেখানে ধানের চাষ হতো। ধারণা করা হয়, চীনের ইয়াংসি নদীর উপত্যকার আদিম উপজাতিরা প্রথম ধানের চাষ শুরু করে।

এরপর এই ধান ধীরে ধীরে তিব্বত, কোরিয়া, জাপান এবং তাইওয়ানে ছড়িয়ে পরে। ১৪৯২ সালে বাণিজ্য ও অভিবাসনের মাধ্যমে এটি আমেরিকাতেও পৌঁছে যায়। শুধু এশিয়াতেই নয়, আফ্রিকার মানুষও প্রায় ৩,০০০ বছর আগে নিজস্ব প্রজাতির ধান (Oryza glaberrima) চাষ করতে শুরু করে।

ধান চাষের জন্য প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়। এক কেজি ধান ফলাতে প্রায় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ লিটার জল লাগে। অন্যান্য শস্যের তুলনায় এটি অনেক বেশি।

উদাহরণস্বরূপ, একই পরিমাণ গম ফলাতে প্রায় ৯০০ লিটার এবং আলু চাষে প্রায় ৫০০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়। তবে মজার বিষয় হলো, ধানের আসলে খুব বেশি জলের প্রয়োজন হয় না।

তাহলে কেন ধানখেতে জল দেওয়া হয়? ধান একটি অর্ধ-জলজ উদ্ভিদ, অর্থাৎ এটি জলমগ্ন অবস্থায় থাকতে পারে। মূলত আগাছা ও পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচানোর জন্যই ধানখেতে জল দেওয়া হয়।

জাপানে একসময় চাল মুদ্রার মতো ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় জাপানে চাল অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ‘কোকু’ নামক এক এককে চালের পরিমাণ মাপা হতো।

এক কোকু মানে হলো এক জন মানুষের এক বছরের খাদ্য হিসেবে প্রয়োজনীয় চাল, যা প্রায় ১৮০ লিটারের সমান। জাপানের অভিজাত class তাদের জমির ধান উৎপাদনের পরিমাণ দিয়ে নিজেদের ঐশ্বর্য পরিমাপ করত।

এমনকি কর পরিশোধ এবং বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রেও চাল ব্যবহার করা হতো। আধুনিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু হওয়ার পরেও চাল জাপানের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।

সারা বিশ্বে প্রায় ১,২০,০০০ ধরনের চাল পাওয়া যায়। চাল সাধারণত শস্যের আকার, প্রক্রিয়াকরণের ধরন, স্টার্চের পরিমাণ এবং স্বাদ অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।

যেমন—লম্বা, মাঝারি বা ছোট আকারের চাল, সাদা চাল, বাদামি চাল, আঠালো চাল ইত্যাদি। বাজারে পাওয়া যায় এমন অন্যান্য চালের মধ্যে রয়েছে—পরিশোধিত চাল, বাসমতী চাল এবং মিষ্টি চাল।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—‘বন্য চাল’ আসলে চাল নয়। এটি একটি বিভ্রান্তিকর নাম। আসল চাল ‘Oryza sativa’ প্রজাতির, যেখানে বন্য চাল ‘Zizania’ নামক ভিন্ন একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।

আগে বন্য চাল জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা হতো, যা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে বন্য চাল চাষ করা হয়।

সংরক্ষণ করে রাখলে, কাঁচা চাল বছরের পর বছর ভালো থাকে। সাদা চাল সাধারণত ২ বছরের মধ্যে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে এটি অনেক দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।

চাল শুকনো ও ঠান্ডা স্থানে রাখা উচিত, যেখানে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে। এমনকি ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও, অক্সিজেন শোষক ব্যবহার করে চাল ১০ বছর পর্যন্ত ভালো রাখা যেতে পারে।

ধানখেতকে শিল্পকর্মের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা ‘রাইস প্যাডি আর্ট’ বা ‘টাম্বো আর্ট’ নামে পরিচিত। জাপানের ইনাকাদাতে গ্রামে ১৯৯৩ সালে এই শিল্পের জন্ম হয়।

বিভিন্ন রঙের ধানের চারা রোপণ করে মাঠের মধ্যে বিশাল চিত্র তৈরি করা হয়, যা উপর থেকে দেখলে বোঝা যায়। প্রথমে মাত্র চারটি প্রকার ধান ব্যবহার করা হলেও, বর্তমানে এটি স্থানীয়দের কাছে একটি আকর্ষণীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে এবং পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়েছে।

চীন প্রাচীর তৈরিতে আঠালো চাল ব্যবহার করা হয়েছিল। মিং রাজবংশের সময় চীনের বিশাল প্রাচীর নির্মাণের সময় প্রকৌশলীরা উপলব্ধ সব উপকরণ ব্যবহার করেন।

তাঁরা আঠালো চাল এবং পাথুরে চুন মিশিয়ে এক বিশেষ ধরনের মর্টার তৈরি করেন। এই মর্টার সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই ছিল, যা প্রাচীরটিকে দীর্ঘকাল ধরে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

বিজ্ঞানীরা মহাকাশেও ধান চাষ করেছেন। ২০২২ সালে চীনের তিয়াংগং মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা ধানের বীজ রোপণ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই বীজ থেকে চারা গজিয়েছিল এবং নতুন বীজও উৎপন্ন হয়েছিল।

এই আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে উদ্ভিদের জীবনধারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেছেন।

ত্বকের যত্নেও চালের ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে চাল থেকে তৈরি স্কিন কেয়ার পণ্যের বাজার প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।

প্রাচীন জাপানি মহিলারা ত্বক ও চুলের যত্নে চালের পানি ব্যবহার করতেন। আধুনিক বিজ্ঞানও এখন অ্যান্টি-এজিং, ত্বক উজ্জ্বল করা এবং ময়েশ্চারাইজ করার জন্য চালের উপকারিতা নিয়ে গবেষণা করছে।

চাল থেকে তৈরি ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার, টোনার এবং ফেস মাস্ক বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়।

দুটি বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানির নামও চালের সঙ্গে সম্পর্কিত। Honda Motor Company-র নামকরণ করা হয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের নামানুসারে। জাপানি ভাষায় ‘হোন্ডা’ শব্দের অর্থ হলো ‘প্রধান ধানক্ষেত’।

একইভাবে, Toyota-র প্রতিষ্ঠাতা কিচিরো তোয়োদার পদবি থেকে এই নাম এসেছে, যার অর্থ ‘সুন্দর ধানক্ষেত’।

ভাত শুধু আমাদের খাদ্যই নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

তথ্য সূত্র: Travel and Leisure

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *