নদীর জীবন: রবার্ট ম্যাকফার্লেনের চোখে বিশ্বজুড়ে নদ-নদীর সংকট ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা – এই তিন প্রধান নদী এবং তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা আমাদের জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কৃষি, মৎস্য চাষ, জল পরিবহন থেকে শুরু করে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের মতো, আমাদের দেশের নদ-নদীগুলোও আজ হুমকির মুখে। সম্প্রতি প্রকাশিত রবার্ট ম্যাকফার্লেনের নতুন বই ‘ইজ আ রিভার অ্যালাইভ?’ (Is A River Alive?) আমাদের সেই সংকট সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
বইটিতে লেখক নদীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ম্যাকফার্লেন মনে করেন, নদীকে নিছক একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে না দেখে, বরং জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তাঁর মতে, নদীরও জীবন আছে, মৃত্যু আছে।
মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপের কারণে নদ-নদীগুলো আজ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, কোথাও কোথাও তারা মরণাপন্ন। দূষণ, বাঁধ নির্মাণ, নির্বিচারে জল ব্যবহারের ফলে অনেক নদী আজ মৃতপ্রায়।
ম্যাকফার্লেন তাঁর বইয়ের জন্য বিশ্বের তিনটি ভিন্ন অঞ্চলের নদী পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইকুয়েডরের লস সেড্রস নদী, ভারতের চেন্নাইয়ের নদী এবং কানাডার ম্যুটহেকাউ শিপু (ম্যাগপাই নদী)। এই নদীগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে তিনি নদীর বাস্তুসংস্থান, মানুষের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক এবং নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছেন।
ইকুয়েডরে নদীর অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে খনিজ উত্তোলনকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। ভারতে নদীর দূষণ এবং কানাডায় বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
বইটিতে ম্যাকফার্লেন বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন নদীর অধিকারের ধারণার ওপর। তিনি উল্লেখ করেছেন, একজন ভারতীয় নদী অধিকার কর্মী শ্রীষ্টি বাজপাইয়ের কথা, যিনি বলেছিলেন, “নদীর গান গাওয়ার অধিকার আছে।”
অর্থাৎ, যখন নদী ভালো অবস্থায় থাকে, তখন সে কলকল করে বয়ে চলে, যেন গান গায়। আর যখন এটি দুর্বল ও শুকনো হয়ে যায়, তখন তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নদীর এই সংকট আরও গভীর। আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো একদিকে যেমন দূষণ ও দখলের শিকার, তেমনই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যার কারণে নদীর ভাঙন একটি নিয়মিত ঘটনা। অন্যদিকে, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে অনেক নদী মরে যায়।
নদী রক্ষার জন্য আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। দূষণ রোধ, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বজায় রাখা, এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা জরুরি।
এছাড়াও, নদীর প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা দরকার। নদীকে ভালোবাসতে হবে, নদীর গুরুত্ব অনুভব করতে হবে এবং এর সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।
রবার্ট ম্যাকফার্লেনের বইটি আমাদের নদীর প্রতি নতুন করে ভাবতে শেখায়। এটি শুধু একটি বই নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা। নদ-নদীকে বাঁচানোর জন্য এখনই পদক্ষেপ না নিলে, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক