রুমের গুপ্ত প্রকোষ্ঠে পোপদের সমাধি: রহস্যে মোড়া ইতিহাসের পাতা।
ইতালির রাজধানী রোম, এক প্রাচীন শহর। শুধু স্থাপত্য আর শিল্পের জন্যেই নয়, এই শহরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের নানা অজানা গল্প। আর সেই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপেরা।
গত প্রায় দু’হাজার বছর ধরে, প্রায় সব পোপের সমাধি হয়েছে এই শহরেই—ক্যাটাগম্ব, বেসমেন্ট বা গোরস্থানে।
প্রথম পোপ সেন্ট পিটার ছিলেন যিশু খ্রিষ্টের শিষ্যদের একজন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সেন্ট পিটারকে সম্ভবত ৬৪ খ্রিস্টাব্দে শূলে চড়ানো হয়। তাঁর সমাধিস্থল ছিল একটি নেক্রোপলিস বা মৃতের শহর, যা টাইবার নদীর ওপারে, রোমের বাইরে অবস্থিত ছিল।
১৯৩০-এর দশকে সেই নেক্রোপলিসের ধ্বংসাবশেষ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নিচে পাওয়া যায়। ভ্যাটিকান সিটির দেয়ালের নিচেও এই ধরনের সমাধিস্থলের কিছু অংশ সম্প্রতি জনসাধারণের জন্য খোলা হয়েছে।
শুরুর দিকের পোপেরা ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত এক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের নেতা। তাঁদের সমাধিস্থ করা হতো গোপন আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাটাগম্বগুলিতে, যা অ্যাপিয়ান ওয়ে-এর পাশে নরম পাথরের গভীরে তৈরি করা হয়েছিল। এই সমাধিক্ষেত্রগুলো ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্যাঁতসেঁতে এবং কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
সেখানে অসংখ্য সমাধির স্থান ছিল, যেখানে আদি খ্রিস্টানরা রোমান সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতেন।
পরবর্তীতে, সম্রাট কনস্টান্টাইন সেন্ট পিটারের সমাধির স্থানে একটি গির্জা তৈরি করেন। সেই গির্জাটিই পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় হয়ে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর নকশায় সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় পরিণত হয়।
এই ব্যাসিলিকার ভল্টগুলি শুধু পোপদের জন্যেই নয়, ইউরোপের রাজপরিবারের সদস্যদেরও সমাধিস্থল। এখানে প্রায় নব্বই জনের বেশি পোপের সমাধি রয়েছে।
তবে, চতুর্দশ শতকে পোপ যখন ফ্রান্সের আভিঁয়োতে নির্বাসিত ছিলেন, তখন সাতজন পোপ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সমাধিস্থ হতে পারেননি।
পোপদের সমাধির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল পোপ ফরমোসুসের ক্ষেত্রে। তাঁর মৃত্যুর সাত মাস পর, তাঁর উত্তরসূরি ষষ্ঠ স্টিফেন তাঁর মৃতদেহ কবর থেকে তুলে এনে বিচারের জন্য হাজির করেন। মৃত পোপের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অবৈধভাবে পোপের পদ দখল করেছিলেন।
বিচারের পর ফরমোসুসের পোশাক খুলে নেওয়া হয়, তাঁর তিনটি আঙুল কেটে ফেলা হয়, যেগুলি দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করতেন। এরপর তাঁর দেহ টাইবার নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। যদিও তাঁর দেহ ভেসে আসে এবং কথিত আছে, তিনি অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন।
পরবর্তীতে ষষ্ঠ স্টিফেনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তাঁকে কারাগারে হত্যা করা হয়। অবশেষে, ফরমোসুসের দেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় ফিরিয়ে আনা হয়।
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় আরও সমাধিস্থ আছেন সুইডেনের রানি ক্রিস্টিনা এবং ইংল্যান্ডের সিংহাসনের দাবিদার স্টুয়ার্ট পরিবারের সদস্যরা। ব্যাসিলিকার কাছেই রয়েছে টিউটোনিক গোরস্থান, যেখানে বিভিন্ন রাজপরিবারের সদস্যদের কবর রয়েছে।
১৯৮৩ সালে এক তরুণী, ইমানুয়েলা অরল্যান্ডির নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার তদন্তের সূত্রে, এই গোরস্থানে ১৯ শতকের দুজন জার্মান রাজকুমারীর কবর খোঁড়া হয়। কিন্তু সেখানে তাঁদের কোনো দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। অরল্যান্ডির রহস্য আজও অমীমাংসিত।
বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস তাঁর পূর্বসূরিদের পথ অনুসরণ করে গেছেন। তিনি ভ্যাটিকানের প্রথা ভেঙে সাধারণ জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন। ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর, তিনি কার্ডিনালদের সঙ্গে বাসে করে হোটেলে ফিরেছিলেন এবং বিল পরিশোধ করেছিলেন।
তিনি বিশাল প্রাসাদে না থেকে ভ্যাটিকানের গেস্ট হাউসে থাকতে পছন্দ করেন। এমনকি, রোমের দক্ষিণে অবস্থিত তাঁর গ্রীষ্মকালীন বাসভবন ক্যাসেল গান্ডলফোও জনসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও ছিল প্রথা ভেঙে গড়া। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর প্রয়াণ যেন তাঁর মতোই সাদামাটা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, পোপদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল আড়ম্বরপূর্ণ।
যেমন, পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট তিনটি কফিনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে রাখা হয়েছিল তাঁর শাসনামলের প্রতিটি বছরের জন্য কিছু মুদ্রা। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের কফিন ছিল সাধারণ কাঠের তৈরি, যা সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার মেঝেতে রাখা হয়েছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, পোপ ফ্রান্সিস সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সমাধিস্থ না হয়ে, এসকুইলাইন হিলের সান্তা মারিয়া ম্যাজোরে ব্যাসিলিকায় সমাহিত হতে চেয়েছিলেন। ১৬৭৯ সালের পর তিনিই প্রথম পোপ যিনি সেখানে সমাধিস্থ হলেন।
সান্তা মারিয়া ম্যাজোর-এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ৪৩২ খ্রিস্টাব্দে। এখানকার প্রাচীন মোজাইকগুলিতে কুমারী মেরির ছবি রয়েছে, যা বিশ্বের প্রাচীনতম চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম।
পোপ ফ্রান্সিসের এই ব্যাসিলিকার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি তাঁর পোপ হওয়ার শুরু থেকেই প্রত্যেক বিদেশ সফরের আগে ও পরে সেখানে প্রার্থনা করতেন। এমনকি, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির জন্যেও তিনি সেখানে প্রার্থনা করেছিলেন।
তাঁর শেষ ইচ্ছানুসারে, তাঁকে কোনো বিশেষ অলংকরণ ছাড়াই, শুধু তাঁর পোপীয় নাম “ফ্রান্সিসকাস” লিখে সমাধিস্থ করা হয়েছে। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ বহন করেছেন একজন “শুভাকাঙ্ক্ষী।”
মৃত্যু, সমাধি এবং পুনর্জন্ম—এগুলি খ্রিস্টান বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রোম বহু সাম্রাজ্য, রাজা এবং পোপের উত্থান-পতন দেখেছে। পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়তো প্রথা ভেঙেছে, কিন্তু তিনি এই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেছেন, যা দুই সহস্রাব্দ ধরে চলে আসছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক