আশ্চর্যজনক! প্রাচীন রোমের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক গোপন সুড়ঙ্গ নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যা শীঘ্রই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতে চলেছে। ইতালির রাজধানী রোমের কেন্দ্রস্থলে, ক্যাপিটলাইন হিলের নিচে অবস্থিত এই সুবিশাল সুড়ঙ্গপথগুলি (Grottino del Campidoglio) কয়েক শতাব্দী ধরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নীরবে টিকে ছিল।
খুব শীঘ্রই, ২০২৬ সালের শেষ অথবা ২০২৭ সালের শুরুতে, পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই গুপ্তধনের দুয়ার।
এই সুড়ঙ্গগুলির গভীরতা প্রায় ৯৮৫ ফুট, যা এটিকে একটি অসাধারণ এবং আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে। এর বিস্তৃতি প্রায় ৩,৯০০ বর্গমিটার, যা একটি ফুটবল মাঠের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের সমান।
এই সুড়ঙ্গগুলি প্রাচীন রোমান ফোরাম এবং ২,০০০ বছরের পুরনো মার্সেলো থিয়েটারের নিচে অবস্থিত।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, এই সুড়ঙ্গগুলির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে। মধ্যযুগে এটির ব্যাপক উন্নতিসাধন করা হয় এবং ১৯২০ সাল পর্যন্ত এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
একসময় এখানে মানুষের বসবাস ছিল, ছিল দোকান, পানশালা এবং রেস্টুরেন্টও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা হামলা থেকে বাঁচতে মানুষজন এখানে আশ্রয় নিয়েছিল।
বর্তমানে, ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি এই সুড়ঙ্গগুলির কিছু অংশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে এখন সেগুলিকে সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রধান দায়িত্বে আছে ‘ইনসুলা আর্কিটেকচার গ্রুপ’।
এই সুড়ঙ্গ পথের ভেতরে প্রবেশ করলে যেন সময় থেমে যায়। এখানকার কিছু পথ ভালোভাবে তৈরি করা, যা ১৯ শতকে করা হয়েছিল। আবার কিছু পথ তৈরি হয়েছে ‘টাফ’ নামক এক ধরনের আগ্নেয় শিলা দিয়ে, যা রোমের সাতটি পাহাড় তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
আর্কিওলজিস্ট এরসিলিয়া ডি’অ্যামব্রোসিও (Ersilia D’Ambrosio) এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, এই সুড়ঙ্গগুলিতে প্রত্নতত্ত্ব এবং গুহা-পর্যটনের এক দারুণ মিশ্রণ দেখা যাবে, যা সাধারণ পর্যটকদের থেকে একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা দেবে।
এখানে আসা দর্শনার্থীরা প্রাচীন স্থাপত্য এবং ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে। একটি সুড়ঙ্গের দিকে তাকালে, ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ‘টেম্পল অফ জুপিটার’-এর সাদা মার্বেলের ভিত্তি আজও দেখা যায়।
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, একসময় এই সুড়ঙ্গগুলি পাথর খনির কাজে ব্যবহার করা হতো। পরে জল সংরক্ষণের স্থান হিসেবে এবং বাণিজ্যিক কাজকর্মের কেন্দ্র হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯ শতকে, এই সুড়ঙ্গগুলির আশেপাশে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের বাসস্থান ছিল। এমনকি, বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক জোহান উলফগ্যাং ফন গ্যাটে (Johann Wolfgang von Goethe) এখানে আসা এক নারীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে সে কথা লিখেছিলেন।
মুসোলিনি তাঁর আধুনিক রোম গড়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখানকার কিছু বাড়িঘর ভেঙে ফেলেন এবং কিছু সুড়ঙ্গ মাটি দিয়ে ভরাট করে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, এই সুড়ঙ্গগুলির কিছু অংশ বোমা হামলার আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
পর্যটকদের জন্য সুড়ঙ্গগুলি নিরাপদ করতে প্রায় ২.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় ৩০ কোটি টাকার সমান) খরচ করা হচ্ছে। এখানে রেডন গ্যাস ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সুড়ঙ্গগুলিতে বাতাস চলাচলের জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতে, এখানে একটি জাদুঘর তৈরি করা হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য গাইডদের তত্ত্বাবধানে সুড়ঙ্গগুলিতে প্রবেশের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে।
এখানে প্রাচীন পাথরের বিভিন্ন শিল্পকর্ম, মাটির পাত্র, এবং মশলার ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শিত হবে।
আর্কিওলজিস্ট এরসিলিয়া ডি’অ্যামব্রোসিও বলেছেন, এই সুড়ঙ্গগুলি আগে কখনও জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। তিনি আরও জানান, এই স্থানটি আগে গুদামঘর, দোকান এবং পানশালা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, পর্যটকদের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন