মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলদের (রাজ্যের প্রধান আইন কর্মকর্তা) একটি রোম সফর ঘিরে বর্তমানে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের এই বিদেশ ভ্রমণটি আয়োজন করা হয়েছিল এমন একটি সংস্থা কর্তৃক, যাদের অর্থায়ন আসে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা থেকে। এই সফরের কারণে কর্মকর্তাদের স্বার্থের সংঘাত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অ্যাটর্নি জেনারেলদের এই রোম সফরের মূল উদ্যোক্তা ছিল ‘অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যালায়েন্স’ (এজিএ) নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি মূলত বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে থাকে। এই অনুদানের অর্থ ব্যবহার করেই অ্যাটর্নি জেনারেলদের জন্য বিলাসবহুল হোটেল, ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে ভ্রমণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সফরে অংশগ্রহণকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের মধ্যে ছিলেন আলাস্কার অ্যাটর্নি জেনারেল ট্রেগ টেইলর, লুইজিয়ানার অ্যাটর্নি জেনারেল লিজ মুরিল এবং ইডাহোর অ্যাটর্নি জেনারেল রাউল লাব্রাডর। এছাড়াও, মেরিল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যান্টনি ব্রাউন এবং আরকানসাসের অ্যাটর্নি জেনারেল টিম গ্রিফিনও এই সফরে অংশ নিয়েছিলেন। এই সফরকালে অ্যাটর্নি জেনারেলদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার প্রতিনিধি, আইনজীবী এবং লবিস্টদেরও দেখা গেছে।
এই সফরের বিষয়ে সমালোচকরা বলছেন, কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তাদের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করাটা অ্যাটর্নি জেনারেলদের কার্যকারিতা এবং সততার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে। কারণ, অ্যাটর্নি জেনারেলদের মূল দায়িত্ব হলো প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা। এমন পরিস্থিতিতে, এই ধরনের সম্পর্ক তাঁদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন গিলার্স বলেন, “এ ধরনের বিলাসবহুল ভ্রমণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলরা তাঁদের পদের সম্মানহানি করেন।”
তবে, এজিএ-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোম সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ভ্যাটিকান কর্মকর্তাদের সঙ্গে মানব পাচারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। এছাড়াও, অ্যাটর্নি জেনারেলদের জন্য এই সফরে বিশেষ আইনি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। এজিএ’র জেনারেল কাউন্সেল তানিয়া ম্যায়েস্টাস্ বলেছেন, এই সফরে কোনো ধরনের মামলার বিষয়ে আলোচনা হয়নি এবং এই সফরকে আইনবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে মেলানো ঠিক নয়।
সফরের বিস্তারিত সূচি থেকে জানা যায়, প্রতিদিন সকালে আইন প্রয়োগ বিষয়ক আলোচনা সভার পাশাপাশি জাদুঘর পরিদর্শন এবং সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ভ্রমণের মতো বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রমও ছিল। অংশগ্রহণকারীদের জন্য ফাইভ-স্টার হোটেল রোম ক্যাভালিয়ারিতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
এই সফরের খরচ সম্পর্কে জানা যায়, এজিএ অ্যাটর্নি জেনারেল ও তাঁদের অতিথিদের জন্য বিজনেস ক্লাসের টিকিটের ব্যবস্থাও করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রাউন ও তাঁর স্ত্রীর জন্য ১৪,০০০ ডলারেরও বেশি মূল্যের টিকিট সরবরাহ করা হয়েছিল। এছাড়াও, ওহাইও’র অ্যাটর্নি জেনারেল ডেভ ইয়োস্ট ও তাঁর স্ত্রীর টিকিটও এজিএ-এর পক্ষ থেকে বুক করা হয়েছিল।
এজিএ-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সংস্থাটি প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি স্পন্সরশিপ সংগ্রহ করেছে। সাধারণত, বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলো এই অনুদান দিয়ে থাকে। এছাড়াও, অ্যাটর্নি জেনারেলরা তাঁদের সদস্য ফি বাবদ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন, যা আসে করদাতাদের তহবিল থেকে।
এই সফরের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, বিভিন্ন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মধ্যে ৩২টি জানিয়েছে, তাঁরা এই সফরে অংশ নেননি। ১৬টি অফিস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। মেরিল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস নিশ্চিত করেছে যে তিনি এই সফরে অংশ নিয়েছিলেন। আরকানসাসের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস জানায়, তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে এই সফরে গিয়েছিলেন এবং এজিএ থেকে মানব পাচার প্রতিরোধের জন্য ১ লক্ষ ডলার অনুদান সংগ্রহ করেছেন।
এই সফরের সময় লুইজিয়ানা অ্যাটর্নি জেনারেল লিজ মুরিলকে উইলমারহেইল নামক একটি আন্তর্জাতিক আইন সংস্থার প্রতিনিধি পল কনেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এই সংস্থাটি ব্ল্যাকরক নামক একটি সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে একটি মামলা চলছে।
এ বিষয়ে লিজ মুরিল এক সাক্ষাৎকারে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যালায়েন্স একটি সদস্যপদ সংস্থা, তবে এর অনেক মূল্য রয়েছে। এর মাধ্যমে আপনি অনেক অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।”
সার্বিকভাবে, এই ঘটনাটি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সম্পর্ক এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের সম্পর্ক সরকারি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা এবং স্বচ্ছতার পথে কতটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন