রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলার: ইউক্রেনের জন্য কি পদক্ষেপ?

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য রাশিয়ার জব্দকৃত ৩০০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ ব্যবহারের বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানো কিছু দেশ চাইছে এই বিশাল পরিমাণ অর্থ সরাসরি বাজেয়াপ্ত করে কিয়েভকে দিতে, যা দেশটির পুনর্গঠন ও সামরিক খাতে সহায়ক হবে।

অন্যদিকে, ফ্রান্স, জার্মানি এবং বেলজিয়ামের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো এর বিরোধিতা করছে। তাদের মতে, এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হতে পারে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরপরই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সম্পদ জব্দ করা হয়েছিল। বর্তমানে, এই অর্থের বড় অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে বেলজিয়ামের ইউরোক্লিয়ার ক্লিয়ারিং হাউসে জমা রয়েছে।

এর বাইরে যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতেও এই সম্পদ রাখা আছে।

ইতিমধ্যে, জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো জব্দকৃত অর্থের সুদ থেকে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে দিয়েছে। তবে সরাসরি মূল অর্থ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকে উদ্বিগ্ন।

পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো—লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া—রাশিয়ার এই সম্পদ পুরোপুরি বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে। তাদের যুক্তি হলো, রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের পুনর্গঠনে আগামী দশ বছরে প্রায় ৫২৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন।

তবে ফ্রান্স, জার্মানি ও বেলজিয়ামের মতো দেশগুলোর আশঙ্কা, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে এবং ভবিষ্যতে কোনো শান্তি আলোচনায় দর কষাকষির সুযোগ কমে যাবে।

ফরাসি অর্থমন্ত্রী এরিক লম্বার্ড সম্প্রতি বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী বার্ট ডি ওয়েভারও এই বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তাদের মতে, এমন পদক্ষেপ ইউরোপীয় আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে বিনিয়োগকারীরা ইউরোপীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, যা ইউরোর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব ফেলবে।

এমনকি, সৌদি আরব ও চীনের মতো দেশগুলো ইউরোপীয় সরকারি বন্ড বিক্রি করতে পারে, যা দেশগুলোর ঋণ গ্রহণের খরচ বাড়িয়ে দেবে।

তবে কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা উচিত। তাদের যুক্তি হলো, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙতে বাধ্য করতে এটি একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।

তাদের মতে, আগ্রাসকের সম্পদ ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে সাহায্য করার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলে তা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হতে পারে।

তবে এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

অতীতে, ইরাক কর্তৃক কুয়েত আক্রমণের শিকারদের ক্ষতিপূরণ এবং ইরানে মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনার ক্ষতিপূরণে জব্দকৃত সম্পদ ব্যবহারের নজির রয়েছে।

তবে সেসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং কূটনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে আইনি ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার যেকোনো প্রচেষ্টা অবৈধ এবং এর গুরুতর পরিণতি হবে।

এমন পরিস্থিতিতে, রাশিয়াও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে, যারা এখনো তাদের দেশে ব্যবসা করছে।

এই বিতর্কের মাঝে, ইউক্রেনের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *