রাশিয়ার কারাগারে: যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলায় সোভিয়েত যুগের বিদ্রোহীর সাজা!

রাশিয়ার একজন প্রবীণ ভিন্নমতাবলম্বীকে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতা করার কারণে ১৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আলেকজান্ডার স্কোবভ নামে ৬৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তিকে সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি সামরিক আদালত শুক্রবার এই সাজা দেয়।

আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, স্কোবভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলেছিলেন এবং ক্রিমিয়া সেতুতে ২০২২ সালের হামলায় সমর্থন জুগিয়েছিলেন। এছাড়াও, তার বিরুদ্ধে বিদেশে অবস্থিত বিরোধী দল ‘ফ্রি রাশিয়া ফোরাম’-এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।

স্কোবভ সোভিয়েত আমলে একজন পরিচিত ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন। তিনি নিজেকে বামপন্থী ও শান্তিবাদী হিসেবে পরিচয় দিতেন। একসময় তিনি ‘পার্সপেকটিভি’ নামে একটি সোভিয়েত বিরোধী পত্রিকা প্রকাশ করতেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত যুদ্ধ, চেচনিয়ার যুদ্ধ এবং সবশেষ ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধেরও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেন।

সোভিয়েত আমলে স্কোবভের বিরুদ্ধে ‘সোভিয়েত বিরোধী প্রচার ও প্রোপাগান্ডা’ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তাকে দু’বার মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি মোট ছয় বছর বন্দী ছিলেন।

বার্ধক্য এবং শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় এই কারাদণ্ডকে কার্যত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সমতুল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্কোবভের আইনজীবী জানিয়েছেন, তার মক্কেল ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস সি, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা এবং গ্লুকোমার মতো রোগে ভুগছেন।

রায় ঘোষণার আগে আদালতে দেওয়া শেষ বক্তব্যে স্কোবভ ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, “আজ আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে আমি দোষী কিনা। আমিই বরং এখানে অভিযুক্ত করছি! আমি একটি দুর্গন্ধযুক্ত শাসনের কঙ্কাল এবং পুতিনের নেতৃত্বাধীন চক্রকে অভিযুক্ত করছি। তারা আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করেছে, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ করেছে, রাশিয়ায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালিয়েছে এবং আমার জনগণের নৈতিক অবক্ষয় ঘটিয়েছে।”

আদালতে উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, “আমি জানতে চাই, পুতিনের অপরাধে সহযোগী হতে আপনারা কি নিজেদের দোষ স্বীকার করেন?”

রায় শোনার সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কড়া পাহারায় একটি লোহার খাঁচার ভেতরে বসে থাকা স্কোবভ চিৎকার করে ওঠেন, “ইউক্রেনের জয় হোক!”

২০২৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে স্কোবভ কারাবন্দী রয়েছেন। কারাগারে থেকেও তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। গত জুন মাসে তিনি তরুণ রুশ রাজনৈতিক বন্দীদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখেন। ‘নোভায়া গেজেটা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, “আমি চাই, তরুণ প্রজন্ম যারা আঘাত পেয়েছে, তারা জানুক যে শেষ সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বীরা তাদের পাশে ছিল।”

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্কোবভকে দেওয়া এই সাজা বর্তমান রাশিয়ার দমননীতির চরম দৃষ্টান্ত। তাদের মতে, আজকের রাশিয়ায় নিপীড়নের মাত্রা স্তালিন- পরবর্তী সোভিয়েত আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের সহযোগী পরিচালক তানিয়া লকশিনা বলেছেন, “আলেকজান্ডার স্কোবভকে দেওয়া এই কঠোর সাজা রাশিয়ার কর্তৃপক্ষের ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতীক। একইসঙ্গে তারা ইউক্রেনেও যুদ্ধাপরাধ ঘটাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “এটা খুবই মর্মস্পর্শী যে স্কোবভ অতীতে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সোভিয়েত কারাগারে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন এবং চার দশক পরে ইতিহাস আবার নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে।”

২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরুর পর থেকে রাশিয়া ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। এই অভিযান সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত হয়েছে।

২০২৪ সালে রাশিয়ার একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ‘প্রোয়েক্ত’ অনুমান করেছে, পুতিন সরকারের আমলে নিপীড়নের মাত্রা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও লিওনিদ ব্রেজনেভের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত ছয় বছরে অন্তত ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে।

স্কোবভের মামলাটি এটাও ইঙ্গিত দেয় যে, ইউক্রেন যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সরকার দমননীতি শিথিল করার কোনো পরিকল্পনা করছে না। এমনকি যখন ক্রেমলিন ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে শান্তি আলোচনার দাবি করছে, তখনও এই নিপীড়ন চলছে।

সম্প্রতি, রুশ কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ সমালোচনার জন্য চলচ্চিত্র সমালোচক থেকে শুরু করে একজন পেনশনভোগী এবং বেশ কয়েকজন আঞ্চলিক সাংবাদিককে আটক করেছে। তাদের প্রত্যেককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুতিনের ২০২২ সালের আগ্রাসনের নিন্দা করার কারণে দীর্ঘ কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *