যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার ইঙ্গিত, ইউক্রেনকে নিয়ে মস্কোর কটাক্ষ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রথমবারের মতো সরাসরি বৈঠকে বসেছিল দুই দেশ। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই বৈঠকে আলোচনা শুরুর আগেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা ভেস্তে দেওয়ার জন্য রাশিয়া কৌশল আঁটছে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।
বৈঠকে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দূত রডিওন মিরোশনিক। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বা তাঁর মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বৈঠকে যোগ দেন।
বৈঠকের শুরুতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, “বৈঠকে আসা প্রতিনিধি দল ‘ভাঁড়’-এর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁর সম্মোহন কাটুক, অবশেষে তিনি যেন তাঁদের টেবিলে বসতে দেন, যাঁদের তিনি তিন বছর ধরে আলোচনার টেবিলে বসতে দেননি।”
মিরোশনিক আরও বলেন, “আমরা ইউক্রেনীয় আইন পর্যালোচনা করেছি এবং আমরা বুঝতে পেরেছি যে দেশটির বৈধ নেতা হিসেবে জেলেনস্কির ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে।” তিনি মূলত ইঙ্গিত করেন যে গত বছর ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। যদিও ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংকটের সময় জেলেনস্কি তাঁর পদে বহাল থাকতে পারেন এবং দেশটির পার্লামেন্ট তাঁর মেয়াদ যুদ্ধ আইন বহাল থাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
তবে রাশিয়ার এমন মন্তব্যের মাধ্যমে আলোচনার ফল নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া হয়তো কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো এড়াতে চাইছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভবিষ্যতে রাশিয়া যেকোনো সময়ে শান্তি চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে, এমন পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা হিসেবেই এই ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে।”
বৈঠকে ইউক্রেন প্রথমে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় এবং এরপর জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাশিয়া সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা উভয়পক্ষের ১০০০ যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ের প্রস্তাব দেয় এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব লিখিত আকারে জমা দেওয়ার কথা জানায়।
আলোচনা চলাকালীন সময়ে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে হামলা চালায় এবং কিছু এলাকা দখল করে নেয়। শনিবার রাতে রাশিয়া ইউক্রেনের শহরগুলোতে ২৭৩টি ড্রোন হামলা চালায়, যা এই যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা। সোমবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মারিঙ্কো এবং নভোওলেনোভকা শহর দখলের দাবি করে।
কিয়েভের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাশিয়া শর্ত ছাড়াই আলোচনার কথা বললেও, তারা আলোচনার পূর্বে চারটি প্রদেশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে। রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ জোর দিয়ে বলেছেন, ২০১৪ সালে গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়া যে চারটি অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে রাশিয়ার অংশ।
এদিকে, রুশ পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির প্রধান লিওনিদ স্লুৎস্কি জানান, আলোচনার পরবর্তী পর্যায়ে ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থান এবং ন্যাটোর সদস্যপদ ত্যাগ করার বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো উচিত। গত বছর দেওয়া এক ভাষণে পুতিন এই শর্তগুলো উল্লেখ করেছিলেন।
সোমবার আলোচনার সময় জাখারোভা নিশ্চিত করেছেন যে রাশিয়ার লক্ষ্য এখনো আগের মতোই রয়েছে। একই দিনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর পুতিন জানান, রাশিয়া একটি সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির খসড়া নিয়ে ইউক্রেনীয় পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
অন্যদিকে, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে আনতে চাপ সৃষ্টি করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ব্রিজেট ব্রিঙ্ক মনে করেন, ট্রাম্পের আলোচনার কৌশল ইউক্রেনের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের শুরু থেকেই ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, রাশিয়ার ওপর নয়।
ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে। সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার তেল পাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৮৯টি ট্যাংকারের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে রাশিয়ার অস্ত্র প্রস্তুতকারক এবং ২৮ জন বিচারকের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা