রাশিয়ার কারাগারে বন্দী মুসলিমদের ধর্ম পালনে চরম দুর্ভোগ
রাশিয়ায় বসবাসকারী মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও দেশটির কারাগারগুলোতে তাদের ধর্মীয় অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারাগারে বন্দী মুসলিমদের খাদ্য, পোশাক এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সীমিত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ করারও অভিযোগ উঠেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে সাইবেরিয়ার একটি কারাগারে বন্দী হওয়ার পর, ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের নেতা নারিম্যান জহেলিআলকে রুটি ও তরল খাবার খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে।
তিনি জানান, তাকে দেওয়া অধিকাংশ খাবারেই শুকরের মাংস ছিল, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তিনি আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি শুধু রুটি খেতাম, তাও ভালো মানের ছিল না, আর চা দিয়ে কোনোমতে চলত।”
বিস্ফোরক দ্রব্য পাচার ও গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংসের অভিযোগে তাকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কারাগারের বিভীষিকাময় জীবন কেবল খাবারের কষ্টেই সীমাবদ্ধ নয়। কারারক্ষীদের অসহযোগিতা এবং কয়েদিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে মুসলিম বন্দীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
সোভিয়েত ও রুশ কারাগারগুলোতে কয়েদিদের নিজস্ব নিয়মকানুন প্রচলিত আছে। কুখ্যাত ‘কালো কয়েদি’ বা ‘চোরদের রাজা’ নামে পরিচিত কয়েদিরা তাদের শরীরে বিশেষ ধরনের উল্কি ব্যবহার করে এবং কঠোর নিয়মকানুন তৈরি করে।
তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কারাগারগুলোকে ‘কালো কারাগার’ বলা হয়, যেখানে কারারক্ষীরা মাদক পাচার, জুয়া খেলা এবং সহিংসতার মতো বিষয়গুলোতে নীরব ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে, ‘লাল কারাগার’-এ কারারক্ষীদের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে। এখানে কারাবন্দীদের ওপর নির্যাতন, একাকী কারাবাস, অপুষ্টি এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
গত দুই দশকে, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘জঙ্গিবাদ’-এর অভিযোগে হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করার মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বর্তমানে রাশিয়ার প্রায় ১৪ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ শতাংশ মুসলিম।
এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, যেখানে মুসলিম বন্দীর সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, কোনো বন্দী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনকি অনেক সময় তাদের কারাদণ্ডের মেয়াদও বাড়ানো হয়।
রাশিয়ার কারা-নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অফ পানিশমেন্টের সাবেক বিশ্লেষক আনা কারেতনিকোভা আল জাজিরাকে জানান, “যদি কোনো কয়েদি অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়, তবে তাকে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তাকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং কারাগার প্রশাসনকে এজন্য শাস্তি পেতে হয়।”
মধ্য এশিয়া থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা ভাষার দুর্বলতা ও সেখানকার আইন-কানুন সম্পর্কে কম জানার কারণে প্রায়ই নিপীড়নের শিকার হন। তাদের অনেকে জোরপূর্বক ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছে।
এমনকি, রুশ পুলিশ ও প্রসিকিউটরদের বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগও রয়েছে।
আরেকটি উদাহরণ হিসেবে, মস্কোর নির্মাণ শ্রমিক আবদুল আজিজের কথা বলা যায়। তিনি জানান, ২০২২ সালে পুলিশ তার ছোট ভাই আবদুল মুমিনকে ‘স্পাইস’ নামক মাদকদ্রব্য দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়।
এরপর তাকে নির্যাতন করে পার্কের বেঞ্চের নিচে মাদক রাখার ‘স্বীকারোক্তি’ আদায় করা হয়। পরে আদালত আবদুল মুমিনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
কারা-নিয়ম অনুযায়ী, রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত মুসলিম বন্দীদের ঘুমাতে এবং বিছানা ত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়। ফলে তাদের ফজরের নামাজ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে।
রমজানে অনেক বন্দীর জন্য রোজা রাখা কষ্টকর হয়ে যায়।
তবে, কিছু কারাগারে মুসলিম বন্দীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আজাত গাওনুতদিনভ নামের এক ব্যক্তি, যিনি কারাগারে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মুসলিম বন্দীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা শুরু করেন, তিনি জানান, “তাদের ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো উচিত।
মুসলিম বন্দীদের মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে, শুধু নামাজ পড়াই ‘জঙ্গিবাদ’-এর লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়।”
অবশ্য, পরিস্থিতি কারাগার ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। নারিম্যান জহেলিআল যে কারাগারে ছিলেন, সেখানকার কারারক্ষীরা কিছুটা সহনশীল ছিলেন।
তাদের নামাজ পড়ার এবং রমজানের খাবার খাওয়ার অনুমতি ছিল। অন্যান্য কারাগারের মতো সেখানে কোরআন ও ইসলামিক বই নিষিদ্ধ ছিল না।
আল জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে জহেলিআল বলেন, কিছু মুসলিম বন্দী কারাগারের ভেতরের অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত হতে অস্বীকার করেন। যেমন সিগারেট, মোবাইল ফোন অথবা মাদক দ্রব্য পাচার করা থেকে তারা বিরত থাকেন।
জহেলিআল আরও বলেন, “এমন কিছু মুসলিম আছেন যারা বলেন, আপনাদের এই অপরাধমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে আমরা জড়িত হতে চাই না। কারণ, এগুলো একজন মুসলিমের জীবন ধারণের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
২০০০ সালের শুরুর দিকে চেচনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার কারাগারে মুসলিম বন্দীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।
কর্তৃপক্ষের কঠোর নীতি এবং কারাগার প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষক কারেতনিকোভা বলেন, “সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কেবল শাস্তি আর পুরস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে সবকিছু, পরিস্থিতি বোঝার বা কোনো কৌশল তৈরি করার কোনো চেষ্টা নেই।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা