উত্তরের এক প্রান্তে, যেখানে বরফের চাদর মোড়া ভূমি আর গভীর অরণ্য, সেখানেই বাস করেন এক প্রাচীন জনজাতি – সামী। এই জনজাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রা আজও আমাদের জন্য এক মূল্যবান পাঠ। সম্প্রতি জানা গেছে, তাদের জীবন এবং সংগ্রামের গল্পগুলো বর্তমান বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
**সামী: উত্তর ইউরোপের আদিবাসী**
সামীরা উত্তর নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার কিছু অংশে বিস্তৃত সাপমি নামক অঞ্চলে বসবাস করেন। তারা বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল সুরটি এক। কয়েক হাজার বছর ধরে টিকে থাকা এই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে রয়েছে গভীরতা।
**জোইক: অনুভূতির প্রকাশ**
সামী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘জোইক’। এটি এক ধরনের গান, যা তাদের আবেগ, অনুভূতি এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। জোইক কোনো ব্যক্তি, স্থান, প্রাণী বা ঘটনার প্রতি উৎসর্গীকৃত হতে পারে। সামীরা তাদের হৃদয়ের গভীরতা থেকে গান গেয়ে এই জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। একজন সামী পথপ্রদর্শক, রাঁধুনি এবং রেইনডিয়ার পালক, জোন মিক্কেল এইরা, এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “জোইক করার সময় আমি চোখ বন্ধ করে সেই ব্যক্তি, স্থান, ঘটনা বা পশুর ছবি কল্পনা করি।”
**সংগ্রাম ও টিকে থাকার ইতিহাস**
সামী জাতির ইতিহাস সবসময় সুখের ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানা হয়েছে, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তারা হার মানেননি। কঠোর প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নর্ড ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যাস্ট্রি ডাঙ্কার্টসেন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “বিভিন্ন দেশে সামী জনগোষ্ঠীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের উপর উপনিবেশবাদের প্রভাব ছিল এবং বিভিন্ন দেশে তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে।”
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে সামীরা ধীরে ধীরে তাদের অধিকার ফিরে পেতে শুরু করেন। তাদের ঐতিহ্যপূর্ণ রেইনডিয়ার চারণভূমি রক্ষার জন্য তারা আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন। ২০২০ সালে, সুইডেনে সামীরা তাদের আদি ভূমিতে শিকার ও মাছ ধরার অধিকার ফিরে পান, যা ছিল তাদের দীর্ঘ ৩০ বছরের আইনি লড়াইয়ের ফল।
**বর্তমান বিশ্বে সামী সংস্কৃতির গুরুত্ব**
আজকের বিশ্বে সামী সংস্কৃতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সামী শিল্পী মারি বইন বলেছেন, “পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জ্ঞান যেন হারিয়ে না যায়। কারণ, তাদের সংস্কৃতিতে প্রকৃতির সঙ্গে কিভাবে বাঁচতে হয়, সে সম্পর্কে মূল্যবান শিক্ষা রয়েছে।” প্রকৃতিকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে হয় এবং কিভাবে পরিবেশের ক্ষতি না করে জীবন ধারণ করতে হয় – এই জ্ঞানগুলো সামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মারি বইন আরও যোগ করেন, “এই জ্ঞান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন।”
সামী জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং তাদের সংগ্রামের গল্প আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি আমাদের দেখায় কিভাবে প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা যায়, কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচা যায় এবং কিভাবে নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা যায়।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার