সমুদ্রের কাছাকাছি সময় কাটানো মস্তিষ্কের জন্য উপকারী, বলছে বিজ্ঞান।
সমুদ্র বা নদীর ধারে সময় কাটানো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির এই শান্ত রূপ আমাদের মনকে শান্ত করতে এবং শারীরিক সুস্থতাকে বাড়াতে সহায়তা করে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আঠারো শতকে ইউরোপে চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য সমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়ার পরামর্শ দিতেন। যক্ষ্মা থেকে শুরু করে কুষ্ঠরোগের মতো অনেক কঠিন রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীরা সমুদ্রের পানিতে স্নান করতেন এবং তা পানও করতেন।
রাতের বেলা সমুদ্রের বাতাস এবং ঢেউয়ের শব্দে তারা ঘুমাতেন। যদিও সেই সময়ের অনেক চিকিৎসা পদ্ধতি এখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তবে আধুনিক বিজ্ঞান এখনো প্রকৃতির উপকারিতার প্রমাণ দিয়ে চলেছে।
১৯৮৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীদের মধ্যে যাদের হাসপাতালের ঘর প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে ছিল, তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তাদের হাসপাতালের দিনগুলোও অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক ছিল।
এই গবেষণার পর পরিবেশ মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করেন।
তারা মূলত পার্ক ও বনের মতো সবুজ স্থানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেও, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো নীল স্থান বা জলজ পরিবেশের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
পরিবেশ মনোবিজ্ঞানী ম্যাট হোয়াইট এই গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নিজে একজন সার্ফার এবং সাঁতারু।
২০১০ সালে, হোয়াইট এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণা করেন। তারা দেখেন, প্রাকৃতিক এবং নগর পরিবেশের ছবিগুলো মানুষের কাছে আরও আকর্ষণীয় এবং আরামদায়ক মনে হয়, যখন সেগুলোতে জলের উপস্থিতি থাকে।
এই গবেষণা “ব্লু স্পেস” বিষয়ক গবেষণার পথ খুলে দেয়।
তাহলে, সমুদ্র বা নদীর ধারে সময় কাটানো আমাদের শরীরে এবং মস্তিষ্কে কী প্রভাব ফেলে?
প্রথমত, আপনি যখন সমুদ্রের কাছাকাছি যান, তখন আপনার মন শান্ত হতে শুরু করে। পরিবেশ মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে “মনোযোগ পুনরুদ্ধার” বলে অভিহিত করেন।
আপনার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে চারপাশের পরিবেশের প্রতি মনোযোগ দিতে শুরু করে এবং কম মানসিক চাপ অনুভব করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রের কাছাকাছি সময় কাটালে বনভূমি বা পাহাড়ের চেয়ে বেশি মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
“ব্লু স্পেস: হাউ অ্যান্ড হোয়াই ওয়াটার ক্যান মেক ইউ ফিল বেটার” বইয়ের লেখক ক্যাথরিন কেলি মনে করেন, সমুদ্রের বিশালতা এবং এর অবিরাম দৃশ্য আমাদের মনকে শান্ত করে।
সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, দিগন্তের বিস্তৃতি—এগুলো আমাদের এক ধরনের সম্মোহিত অবস্থার দিকে নিয়ে যায়, যা আমাদের সমস্যাগুলো থেকে দূরে রাখে এবং বৃহত্তর কিছুর অংশ হিসেবে অনুভব করায়।
“মনোযোগ পুনরুদ্ধার তত্ত্ব” (Attention Restoration Theory) অনুযায়ী, প্রশান্তিদায়ক পরিবেশ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো।
সমুদ্রের ঢেউ এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। মেরিন সামাজিক বাস্তুবিদ ইaskey Britton বলেছেন, ঢেউগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, যা আমাদের উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেয়।
সমুদ্রকে “নীল জিম” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। এখানে মানুষ হাঁটাচলা, সাঁতার এবং বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে, যা শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ স্থানের চেয়ে নীল স্থানে মানুষ বেশি সময় ধরে ব্যায়াম করে, সম্ভবত জলের কাছাকাছি থাকার কারণে তারা সময়ের বিস্তৃতি অনুভব করে।
২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নীল এবং সবুজ স্থানে বেশি সময় কাটানো ঘুমের অভাবের সম্ভাবনা কমায়।
এছাড়া, সমুদ্রের কাছাকাছি সময় কাটানো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা ঘুমের গুণগত মান উন্নত করে।
সমুদ্রে সময় কাটানো আমাদের ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করতে পারে। যদিও সমুদ্রের পরিবেশ সরাসরি ব্যথানাশক কিনা, তা প্রমাণ করা কঠিন, কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক্ষেত্রে দ্বৈত-অন্ধ পরীক্ষা (double-blind controlled trials) করা সম্ভব নয়।
তবে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু গবেষণা চালানো হয়েছে।
২০১৭ সালের একটি গবেষণায়, ডেন্টাল ক্লিনিকে আসা রোগীদের ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে সমুদ্রের দৃশ্য দেখানো হয়।
এতে দেখা গেছে, যারা সমুদ্রের দৃশ্য দেখেছেন, তাদের ব্যথার অনুভূতি অন্য রোগীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল।
২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে মস্তিষ্কের কিছু অংশে ব্যথার অনুভূতি কমে যায়।
এছাড়াও, সমুদ্রের ধারে সময় কাটানো সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতেও সাহায্য করে।
পরিবারের সঙ্গে সমুদ্রের ধারে সময় কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলা—এগুলো আমাদের স্মৃতি তৈরি করে এবং সম্পর্কের গভীরতা বাড়ায়।
২০১৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রের ধারে কাটানো সময় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন বাড়াতে সাহায্য করে।
সুতরাং, সমুদ্র বা নদীর ধারে সময় কাটানো আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
যদিও একদিনের সমুদ্র ভ্রমণ হয়তো সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, তবে এটি ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে গবেষণা করছেন যে, শৈশবে সমুদ্রের কাছাকাছি কাটানো সময় প্রকৃতির প্রতি আমাদের গভীর সংযোগ তৈরি করে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।
“যদি এমন একটি স্থান থাকে যা আমাদের ভালো অনুভব করায়, তবে নিশ্চিত করতে হবে সেই স্থানটিও যেন ভালো থাকে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক