আজকালকার দিনে কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের সমস্যা যেন একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্বজুড়ে এই সমস্যা বাড়ছে।
পড়াশোনা, খেলাধুলা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—এসবের চাপে ঘুম কম হওয়ায় তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্কুলে, কিশোরদের ঘুমের গুরুত্ব বোঝাতে এবং ভালো ঘুমের অভ্যাস তৈরি করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ম্যানসফিল্ড সিনিয়র হাই স্কুলে ‘স্লিপ টু বি এ বেটার ইউ’ নামে একটি নতুন পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে। এই পাঠ্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থীদের ঘুমের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের ঘুমের অভ্যাস উন্নত করতে সাহায্য করা।
নবম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা হলো, সে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে টিকটক দেখতে ভালোবাসে। অনেকে আবার বন্ধুদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত অনলাইনে গল্প করে।
ক্লাসেও দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী ঘুমিয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর বয়সে ঘুমের এই অভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি বাড়ে।
এছাড়াও, ঘুমের অভাব খেলাধুলায় আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায় এবং তাদের পড়াশোনার পারফরম্যান্সও কমিয়ে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন কিশোরের প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রায় ৮০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে কিশোরদের ঘুমের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বর্তমানে, তারা গড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমোতে পারে না।
এই সমস্যা সমাধানে কিছু স্কুলে ঘুমের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ম্যানসফিল্ড সিটি স্কুলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২১ সালে ক্লাসে অনুপস্থিতির হার ছিল ৪৪ শতাংশ, যা বর্তমানে কিছুটা কমে ৩২ শতাংশ হয়েছে।
ঘুমের সমস্যা সমাধানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে। তারা জানতে পারে, অনেক কিশোর-কিশোরী রাতে দেরিতে ঘুমোতে যায়, সকালে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে এবং এর ফলে স্কুলে যেতে পারে না।
এই পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের ঘুমের একটি দৈনিক হিসাব রাখতে বলা হয়। তারা তাদের মেজাজ এবং শক্তি স্তরও লিখে রাখে।
স্কুলের স্বাস্থ্য শিক্ষক টনি ডেভিস জানান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই জানে না কীভাবে ঘুমাতে হয়। তাদের অনেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অ্যালার্ম সেট করে এবং ফোন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে।
নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নাথান বেকার জানায়, সে ভেবেছিল সে ভালো ঘুমোতে পারে। কিন্তু এই ক্লাসে আসার পর সে বুঝতে পারে, তার ঘুমের অভ্যাসে অনেক ভুল ছিল।
এখন সে রাতে ফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে এবং ঘুমের আগে হালকা গান শোনে। ফলে তার ঘুম ভালো হচ্ছে এবং সে এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো অনুভব করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন পর্যাপ্ত ঘুম মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে। ঘুমের অভাবে মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ, অ্যামিগডালাতে কার্যকলাপ বাড়ে, যা ভয়, রাগ এবং উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার একজন ঘুম বিশেষজ্ঞ কাইলা ওয়ালস্ট্রমের মতে, “কিশোরদের ঘুমের অভাবের কারণে মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অনেক সময় কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী করা হয়।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুমের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আরও গভীর।
ম্যানসফিল্ড স্কুলের এক শিক্ষার্থী, সিনিয়র শ্রেণীর চেজ কোল জানায়, সে ভালো ফলাফল করার জন্য চেষ্টা করছে, একইসাথে খেলাধুলাও করে।
তাই তার ঘুমের সময় কমে যায়। আরেক শিক্ষার্থী অ্যামেলিয়া র্যাফেল জানায়, পড়াশোনার চাপে সে রাতে দেরিতে ঘুমোতে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের ঘুমের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে এবং তাদের ভালো ঘুমের অভ্যাস তৈরি করতে সাহায্য করতে হবে। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের ঘুমের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস