শিক্ষকের গ্রেপ্তার: বিতর্ক জন্ম দিয়েছিল যে ঐতিহাসিক মামলায়!

বিখ্যাত “স্কোপস ট্রায়াল” : বিজ্ঞান বনাম ধর্ম-এর এক ঐতিহাসিক লড়াই।

১৯২৫ সাল। আমেরিকার টেনেসী অঙ্গরাজ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল সারা বিশ্বে। জন টি. স্কোপস নামের এক তরুণ শিক্ষককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, কারণ তিনি তাঁর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিবর্তনবাদ পড়িয়েছিলেন।

এই ঘটনার সূত্র ধরেই শুরু হয় বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে এক চরম বিতর্ক, যা ইতিহাসে “স্কোপস ট্রায়াল” নামে পরিচিত।

আসলে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, আমেরিকায় চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছিল। একদিকে যেমন বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন, তেমনই কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা, বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে এর বিরোধ খুঁজে পাচ্ছিলেন।

তাঁদের মতে, মানুষের সৃষ্টিরহস্য ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে, বিবর্তনবাদের ধারণা ঈশ্বরের ধারণার পরিপন্থী। এই পরিস্থিতিতে, টেনেসীর আইনসভা একটি আইন পাস করে, যা ছিল “বাটলার অ্যাক্ট” নামে পরিচিত।

এই আইনে সরকারি স্কুলে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়।

জন স্কোপস ছিলেন একজন তরুণ শিক্ষক, যিনি যদিও নিশ্চিত ছিলেন না যে তিনি ক্লাসে বিবর্তনবাদ পড়িয়েছিলেন কিনা, তবুও এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাজি হন।

এরপর শুরু হয় এক ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া। এই বিচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিজ্ঞান শিক্ষার স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় অনুশাসন, এই দুটির মধ্যেকার সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা।

এই মামলার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন দু’জন ব্যক্তিত্ব – একদিকে ছিলেন আইনজীবী ক্ল্যারেন্স ড্যারো, যিনি স্কোপসের পক্ষে লড়েছিলেন এবং অন্যদিকে ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান, যিনি বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করছিলেন। বিচার চলাকালীন, ড্যারো এবং ব্রায়ানের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদ হয়, যা সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

আদালতে উভয় পক্ষের আইনজীবীর যুক্তি-তর্কের পাশাপাশি, বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। ড্যারো বিবর্তনবাদের স্বপক্ষে যুক্তি দেন, যেখানে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে এটিকে সমর্থন করেন।

অন্যদিকে, ব্রায়ান বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের পক্ষে কথা বলেন। বিচারের এক পর্যায়ে, ড্যারো ব্রায়ানকে জেরা করেন, যা ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যেকার বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে।

অবশেষে, জন স্কোপসকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাকে ১০০ ডলার জরিমানা করা হয়। যদিও স্কোপস এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা খারিজ হয়ে যায়।

এই মামলার রায় স্কোপসের বিপক্ষে গেলেও, এটি বিবর্তনবাদ এবং বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে।

“স্কোপস ট্রায়াল” শুধু একটি আইনি লড়াই ছিল না, বরং এটি ছিল বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যেকার এক গভীর দ্বন্দ্বের প্রতীক। এই ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞানচর্চা এবং মুক্তচিন্তার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়।

আজও, এই বিচার বিতর্কিত বিষয়গুলোর প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে, যা আমাদের সমাজে বিজ্ঞান ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *