আগুন, উর্বরতা আর উৎসব! স্কটল্যান্ডের প্রাচীন ঐতিহ্য কি?

প্রতি বছর, এপ্রিল মাসের শেষ রাতে, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের ক্যালটন হিলে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। গ্রীষ্মের আগমনকে স্বাগত জানাতে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে আগুনকে কেন্দ্র করে চলে নানা উদযাপন।

উৎসবের রাতে, উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত শিল্পীরা ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়ান, প্রাচীন রীতি অনুযায়ী গান ও বাদ্যযন্ত্রের তালে চলে নানা অনুষ্ঠান।

এই উৎসবটি ‘বেলটেন ফায়ার ফেস্টিভাল’ নামে পরিচিত। এটি ব্রিটেনের অন্যতম বৃহৎ উৎসব, যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো হয়।

এই উৎসবে আগুন, উর্বরতা এবং ঋতু পরিবর্তনের উদযাপন করা হয়। ১৯৮৮ সালে একদল শিল্পী ও স্বেচ্ছাসেবকের হাত ধরে এই উৎসবের পুনর্জন্ম হয়।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে এটি একটি প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

আসলে, কিভাবে একটি প্রায়-বিস্মৃত প্রাচীন উৎসব স্কটল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক অনুষ্ঠানে পরিণত হলো? বেলটেনের উৎস কোথায়?

বেলটেন হল সেল্টিক ক্যালেন্ডারের আটটি ঋতুভিত্তিক উৎসবের মধ্যে অন্যতম। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস এবং ম্যান দ্বীপপুঞ্জে এর শিকড় রয়েছে।

বেলটেন শব্দের অর্থ ‘উজ্জ্বল আগুন’, যা এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এটি গ্রীষ্মের আগমন এবং প্রকৃতির উর্বরতা উদযাপন করে।

ঐতিহাসিকভাবে, এই উৎসবে সবাই তাদের বাড়ির আগুন নিভিয়ে দিত এবং সম্প্রদায়ের সকলে মিলে একটি বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করত।

এই আগুনে সবাই একত্রিত হয়ে উৎসব করত। গবাদি পশুকে এই আগুনের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, যা তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।

এরপর গান, নাচ এবং পানাহারের মধ্যে দিয়ে উৎসব চলতো সারা রাত।

খ্রিস্টপূর্ব বা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের আগমনের আগে থেকেই বেলটেন স্কটিশ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কালের পরিক্রমায় এই উৎসবগুলো শাসকদের দ্বারা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী এতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বেলটেনের ক্ষেত্রে, এটি মে দিবসে রূপান্তরিত হয়।”

বেলটেন ফায়ার সোসাইটির রোমেইন ফারমস্টন-ইভান্স

উনিশ ও বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের উৎসবগুলোর ওপর নিপীড়ন চললেও, বেলটেন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়নি। ১৯৮৮ সালে একদল শিল্পী ক্যালটন হিলে এই উৎসবের পুনরুজ্জীবন ঘটান।

বর্তমানেও স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত এই উৎসব প্রথম বছরে প্রায় ৫০ জন দর্শক নিয়ে শুরু হলেও, ১৯৯৯ সাল নাগাদ এর দর্শক সংখ্যা প্রায় ১০,০০০-এ পৌঁছেছিল।

এডিনবার্গের নেপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রস টিন্সলে, যিনি বেলটেন নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি বলেন, “যেসকল ব্যক্তি এই উৎসবের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন, তারা থ্যাচারবাদের রাজনৈতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলে।”

ঐতিহ্যগতভাবে, বেলটেনের উদযাপন আর্থার’স সিটের ঢালে অনুষ্ঠিত হতো। তবে এই স্থানটি রাজকীয় মালিকানাধীন হওয়ায় এবং রাজনৈতিক প্রতীকীতার কারণে, আয়োজকরা ক্যালটন হিলকে বেছে নেন।

১৯৮০-এর দশকে এই স্থানটি কুইয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল।

আধুনিক উৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে মে কুইন ও গ্রিন ম্যানের গল্প। মে কুইন হলেন ধরিত্রী মাতার প্রতিরূপ, যিনি প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন।

গ্রিন ম্যান সারা উৎসবে মে কুইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু নতুন ঋতুকে আলিঙ্গন করার পরেই তিনি সফল হন।

উৎসবের শেষে তাদের মিলন হয়, যা গ্রীষ্মের সূচনাকে চিহ্নিত করে।

এই গল্পের সঙ্গে প্রকৃতির বিভিন্ন দিক উপস্থাপনকারী অন্যান্য চরিত্রও অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।

মে কুইনের সঙ্গীরা শ্বেতশুভ্র পোশাকে সজ্জিত হয়ে তাঁর আবেগ ও শক্তি প্রকাশ করে। উৎসবের প্রবীণ ব্যক্তিরা নীল পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখেন।

প্রকৃতির বিশৃঙ্খলা ও কামুকতাকে প্রতিনিধিত্ব করে লাল পোশাক পরিহিত দল, যারা প্রায়ই অন্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।

ক্যালটন হিলের এই চার ঘণ্টার অনুষ্ঠানে সবাই এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকে।

বেলটেনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ শুধু এর জাঁকজমকপূর্ণতাই নয়। ফারমস্টন-ইভান্স বলেন, “আমরা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আদিবাসী সংস্কৃতিকে পুনরায় গ্রহণ করার প্রবণতা দেখছি।

এটি স্কটিশদের তাদের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের একটি অংশ।”

বেলটেনের জনপ্রিয়তা আধুনিক জীবনের অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের একটি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

টিন্সলের মতে, “এই বৃদ্ধি ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও আধুনিক পশ্চিমা সমাজের গতির প্রতি অসন্তোষের প্রতিফলন।”

বেলটেন ফায়ার সোসাইটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “বেলটেনের পেছনের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের আদিম প্রকৃতির অনুসন্ধান, ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন, জীবনের উপাদানগুলোর বিশৃঙ্খল ও বন্য গতি এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অতিরিক্ত যুক্তিবাদী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থার বিরোধিতা করা।”

বেলটেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের একটি উৎসব”, যা অনিশ্চিত সময়ে অনেকের কাছে শান্তির বার্তা নিয়ে আসে।

ফারমস্টন-ইভান্স

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *