সমুদ্রে কার্বন: কেমন করে কমাবে দূষণ?

সমুদ্রে কার্বন বন্দী: জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের নতুন উদ্যোগ

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা চলছে। একদিকে যেমন কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) কমানোর চেষ্টা, তেমনই অন্যদিকে পরিবেশ থেকে কার্বন শুষে নেওয়ারও নানা কৌশল নিয়ে গবেষণা চলছে।

কার্বন শোষণের এই প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল এবং এখনো পর্যন্ত খুব বেশি পরীক্ষিত না হলেও, এর গুরুত্ব বাড়ছে দ্রুত। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৬২৮টি কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাজ্যের একটি প্রকল্প সমুদ্র থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।

যুক্তরাজ্য সরকার কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করতে ২০২০ সালে প্রায় ২০ বিলিয়ন পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২.৭ লক্ষ কোটি টাকা) বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে। এর অংশ হিসেবে, ইংলিশ চ্যানেলের কাছে ‘সি-কিয়োর’ (SeaCURE) নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল সমুদ্রের জল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে নেওয়া সম্ভব কিনা, তা পরীক্ষা করা। যদি এটি সফল হয়, তাহলে তা সরাসরি বাতাস থেকে কার্বন শোষণের বিকল্প হিসেবে দেখা যেতে পারে।

প্রকল্পটির প্রধান, এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র ও জলবায়ু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পল হ্যালোরানের মতে, “সমুদ্রের জলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন থাকার কারণ হল, CO2 জলের সাথে মিশে অন্যান্য রূপে জমা হয়, যা সহজে বাতাসের সাথে বিনিময় হয় না।” তিনি আরও জানান, “তবে এর সুবিধা হল, জল থেকে কার্বন অপসারণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ।”

ওয়েমাউথ সি লাইফ সেন্টারে প্রায় এক বছর আগে ‘সি-কিয়োর’ প্রকল্পের একটি পরীক্ষামূলক কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এই কেন্দ্রটি প্রতি মিনিটে ৩,০০০ লিটার সমুদ্রের জল পরিশোধন করতে পারে এবং বছরে প্রায় ১০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের ক্ষমতা রাখে।

প্রকল্পের কর্মীরা সমুদ্রের জল থেকে কার্বন সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। জলের সামান্য অম্লতা বৃদ্ধি করে কার্বন ডাই অক্সাইডকে আলাদা করা হয়।

এরপর বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে কার্বনযুক্ত জলকে একটি বৃহৎ তলের উপর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। হ্যালোরানের মতে, এই প্রক্রিয়ায় জলের প্রায় ৯০ শতাংশ কার্বন শুষে নেওয়া সম্ভব।

পরিশোধিত কার্বন ডাই অক্সাইডকে সক্রিয় কার্বন ব্যবহার করে আরও বিশুদ্ধ করা হয়, যা নারকেল ছোবড়ার মতো উপাদান থেকে তৈরি করা হয়। এরপর একে সংরক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

বৃহৎ আকারে এই কার্বনকে ভূগর্ভে জমা করার পরিকল্পনা রয়েছে। জল থেকে কার্বন অপসারণের পর, সেই জলকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং পরিবেশে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়।

হ্যালোরান ব্যাখ্যা করেন, “এই জল, যা এখন কার্বনমুক্ত, চারপাশের পরিবেশ থেকে কার্বন শুষে নিতে চেষ্টা করে।”

যদিও এই প্রযুক্তির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা এখনো পরীক্ষিত হয়নি, তবে হ্যালোরানের মতে, সরাসরি বাতাস থেকে কার্বন শোষণের তুলনায় এটি বেশি কার্যকর হতে পারে।

কারণ, সমুদ্রের জলে বাতাসের চেয়ে অনেক বেশি কার্বন বিদ্যমান, যা এই প্রযুক্তির জন্য একটি বড় সুবিধা।

সমুদ্র থেকে কার্বন শোষণের ফলে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের উপর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন।

প্রকল্পের গবেষক গাই হুপার জানিয়েছেন, কম কার্বনযুক্ত জল খুব অল্প পরিমাণে পরিবেশে ছাড়া হয় এবং দ্রুত মিশে যায়।

প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, কিছু সামুদ্রিক জীব, যেমন প্লাঙ্কটন এবং শামুক, এই পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

তাই, বৃহত্তর আকারে এই প্রকল্প শুরু করার আগে, পরিবেশের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।

যুক্তরাজ্যের এই প্রকল্পের পাশাপাশি, অন্যান্য দেশ এবং সংস্থাও সমুদ্র থেকে কার্বন সংগ্রহের চেষ্টা করছে। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ক্যাপচুরা’ এবং আমস্টারডাম ভিত্তিক ‘ব্রাইনওয়ার্কস’ এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

এডিনবার্গের কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ বিভাগের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট হ্যাজেলডাইন মনে করেন, ‘সি-কিয়োর’ প্রকল্প বাতাসের কার্বন শোষণের তুলনায় বেশি কার্যকর হতে পারে।

তবে, একটি বৃহৎ আকারের প্রকল্পের জন্য প্রচুর পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রয়োজন হবে।

তিনি আরও বলেন, সমুদ্রের জল থেকে কার্বন পুনরুদ্ধার করার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সমুদ্রের জলে বায়ুমণ্ডলের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি কার্বন জমা থাকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানকার জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন।

তাই, সমুদ্র থেকে কার্বন শোষণের এই ধরনের প্রযুক্তি ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে।

তথ্য সূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *