সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এক অশনি সংকেত
বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, যা উপকূলবর্তী শহর ও জনপদগুলোর জন্য এক চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের কার্যকলাপের ফলস্বরূপ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, যার প্রধান শিকার হচ্ছে সমুদ্র।
নাসার (NASA) সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, গত বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গিয়েছিল। উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ১৯৯৩ সাল থেকে সমুদ্রের উচ্চতা প্রতি বছর যে হারে বাড়ছে, গত ৩০ বছরে তা দ্বিগুণ হয়েছে।
এর ফলস্বরূপ, ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৪ ইঞ্চি বেড়েছে।
বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, কারণ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো—জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং বরফ গলা। এর ফলে সমুদ্রগুলো উত্তপ্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার বিশাল বরফের স্তর গলতে শুরু করেছে।
এই দুটি অঞ্চলের বরফ একসঙ্গে গলতে শুরু করলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ২শ’ ১৩ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ ইঞ্চি এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে, এরপর কী ঘটবে, তা বলা কঠিন।
আমরা পরিস্থিতিকে এতটাই খারাপের দিকে ঠেলে দিয়েছি যে, এখন সমুদ্রের উচ্চতা আরও দ্রুত বাড়তে শুরু করবে।”
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বন্যা, ভূমি ক্ষয়, এবং নোনা পানির অনুপ্রবেশের মতো সমস্যাগুলো বাড়ছে। এর ফলে উপকূলের অনেক শহর, জনপদ এবং দ্বীপরাষ্ট্রগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র টুভালু, কিরিবাতি এবং ফিজি-র মতো দেশগুলো আগামী তিন দশকের মধ্যে অন্তত ৬ ইঞ্চি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির শিকার হবে।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ। আমাদের দেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীবিধৌত অঞ্চল। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য বৃদ্ধিও ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এতে করে উপকূলীয় এলাকার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে, কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং খাবার পানির অভাব দেখা দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো কার্বন নিঃসরণ। তাই, এই সমস্যা মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি। একইসঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
যেমন—বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো আমাদের হাতে। এখনই ব্যবস্থা নিলে হয়তো ভবিষ্যতের বিপদ খানিকটা হলেও কমানো সম্ভব।
এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন (CNN)