স্ব-যত্নের যুদ্ধে গেম: জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে নাকি সহজ?

বর্তমান যুগে ব্যস্ত জীবনযাত্রায় নিজের যত্ন নেওয়া যেন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে মায়েদের জন্য, যখন একদিকে থাকে অফিসের কাজ, অন্যদিকে সংসারের দায়িত্ব, সেখানে নিজের জন্য সময় বের করাটা যুদ্ধ জয়ের মতোই কঠিন।

সম্প্রতি, বাজারে আত্ম-যত্নের জন্য নানান অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপের ছড়াছড়ি। এই অ্যাপগুলো ব্যবহারকারীদের ভালো থাকতে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যার মধ্যে অন্যতম হল গেমিফিকেশন বা খেলার মাধ্যমে অভ্যাস তৈরি করা।

গেমিফিকেশন বিশেষজ্ঞ কিম্বা কুপার-মার্টিন এই প্রবণতা সম্পর্কে বলেন, “গেমিফিকেশন আমাদের মানসিক উদ্দীপনা জাগায়, যেমন–কিছু অর্জন করা, নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং পুরষ্কার পাওয়া। এর ফলে কাজগুলো আরও আকর্ষণীয় হয়, যেন একঘেয়েমি কাটে।”

আসলে, বাজারে উপলব্ধ এইসব অ্যাপগুলো ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে আরও মজাদার করে তোলে। যেমন, পানি পান করা, ব্যায়াম করা, বা ঘুমের মতো বিষয়গুলোও খেলার মাধ্যমে উপভোগ করার সুযোগ থাকে। কিন্তু সত্যিই কি এই গেমিফাইড অ্যাপগুলো আমাদের আত্ম-যত্নে সাহায্য করতে পারে? নাকি এটি অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে?

এই বিষয়টি যাচাই করার জন্য, আমি নিজে কয়েকটি অ্যাপ ব্যবহার করে দেখেছি। যেমন, ‘ফিন্চ’, ‘হ্যাবিটিকা’, ‘এহেড’ এবং ‘পোকিমন স্লিপ’ – এই চারটি অ্যাপ এক সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলতে পারি।

‘ফিন্চ’ অ্যাপটি মূলত একটি ভার্চুয়াল পাখির দেখাশোনার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ভালো থাকতে উৎসাহিত করে। এই অ্যাপে, ব্যবহারকারীদের কিছু লক্ষ্য পূরণ করতে হয়, যেমন–পর্যাপ্ত পানি পান করা, ধ্যান করা বা হালকা ব্যায়াম করা।

এই কাজগুলো সম্পন্ন করার পর, ব্যবহারকারীর ভার্চুয়াল পাখিটি বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারে যায় এবং খুশি হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, অ্যাপটি শুরুতে বেশ আকর্ষণীয় মনে হলেও, অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার কারণে একসময় তা বিরক্তিকর মনে হতে শুরু করে।

এরপর আমি চেষ্টা করি ‘হ্যাবিটিকা’ অ্যাপটি। এই অ্যাপে ভালো অভ্যাস তৈরি এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য পুরষ্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ভালো কাজ করলে ভার্চুয়াল মুদ্রা পাওয়া যায়, যা দিয়ে বিভিন্ন জিনিস কেনা যায়।

অন্যদিকে, খারাপ কাজ করলে ব্যবহারকারী তার ভার্চুয়াল চরিত্রটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে, এই ধরনের বাহ্যিক অনুপ্রেরণা অনেক সময় ভেতরের আগ্রহকে কমিয়ে দেয়। আমার মনে হয়েছিল, ফোন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা উচিত, কারণ এটা আমার মস্তিষ্কের জন্য ভালো, কোনো পুরষ্কারের আশায় নয়।

‘এহেড’ অ্যাপটি আত্ম-উন্নয়নের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা মূলত অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দ্বারা তৈরি। এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীর মানসিক বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে সাহায্য করে।

এখানে ছোট ছোট কোর্সের মাধ্যমে আবেগ নিয়ন্ত্রণ, চিন্তা-ভাবনার ধরন এবং উদ্বেগের কারণগুলো চিহ্নিত করার মতো বিষয়গুলো শেখানো হয়। আমার মতে, অ্যাপটির গঠন বেশ সহজ এবং তথ্যবহুল ছিল, যা আত্ম-উন্নয়নের জন্য একটি ভালো উপায় হতে পারে।

অবশেষে, আমি ‘পোকিমন স্লিপ’ অ্যাপটি ব্যবহার করি, যা ঘুমের অভ্যাস নিরীক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই অ্যাপটি আমার ঘুমের ধরন বিশ্লেষণ করে এবং ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। যদিও আমি পোকেমন সিরিজের সঙ্গে পরিচিত নই, তবুও অ্যাপটি আমার ঘুমের ডেটা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছে।

তবে, এই অ্যাপগুলো ব্যবহারের পর আমার মনে হয়েছে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে অনেক সময় বাস্তব জগৎ থেকে দূরে থাকা হয়। আত্ম-যত্নের ধারণাটি আসলে নিজের জন্য সময় বের করা, যা এই অ্যাপগুলোর মাধ্যমে পাওয়া কঠিন।

একজন ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী ড. ফ্র্যাঙ্কি হ্যারিসন বলেন, “এই অ্যাপগুলোকে সহায়ক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহারের মধ্যে সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রয়েছে। অতিরিক্ত কঠোরভাবে অভ্যাস বা আবেগ ট্র্যাক করা উদ্বেগের কারণ হতে পারে।”

সবশেষে, আমি মনে করি, এই ধরনের অ্যাপগুলো কিছু মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে, যারা গঠনমূলক জীবনযাপন পছন্দ করেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, আত্ম-যত্নের নামে অতিরিক্ত এই গেমিফিকেশন সম্ভবত আমার জন্য নয়।

তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *