স্কটিশ ব্যান্ড সিম্পল মাইন্ডস-এর কথা উঠলেই সম্ভবত সবার প্রথমে চোখে ভাসে ১৯৮৫ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘দ্য ব্রেকফাস্ট ক্লাব’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘ডোন্ট ইউ (ফরগেট অ্যাবাউট মি)’। গানটি শুধু আমেরিকাতেই এক নম্বর স্থান অধিকার করেনি, বরং ব্যান্ডটিকে এনে দিয়েছে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
কিন্তু শুরুতে এই গানের রেকর্ড করতে রাজি ছিল না তারা। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি তথ্যচিত্রে ব্যান্ডের এই না-জানার গল্পটি নতুন করে সামনে এসেছে।
সিম্পল মাইন্ডস-এর প্রধান শিল্পী জিম কের জানান, শুরুতে তারা এই গানটি করতে চাননি, কারণ গানটি তাদের নিজেদের লেখা ছিল না। বিখ্যাত প্রযোজক কিথ ফরসে এবং স্টিভ স্কিফ এই গানটি লিখেছিলেন।
জিম বলেন, “কিথ ফরসে আমাদের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তিনি তখন বেশ মদ্যপ ছিলেন এবং সবার সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি আমাদের কিবোর্ডিস্ট মিক ম্যাকনিলের হাতে একটি ক্যাসেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই, সামনে একটা সুযোগ আসছে’। এমন অনেক মানুষের সঙ্গেই তো দেখা হয়, তবে তাদের সবাই যে কাজের মানুষ হয়, তা তো নয়।
তাই মিক ক্যাসেটটি তার ব্যাগে রাখলেন, সেটি আর শোনাই হয়নি।”
সিম্পল মাইন্ডসের নতুন তথ্যচিত্র ‘সিম্পল মাইন্ডস: এভরিথিং ইজ পসিবল’-এ এই গানটির পেছনের গল্পটি তুলে ধরা হয়েছে। জোস কাওলি পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি ১৩ জুন প্রেক্ষাগৃহে এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে।
বর্তমানে ব্যান্ডটি তাদের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশাল উত্তর-আমেরিকান সফরে আছে।
এই তথ্যচিত্র নিয়ে জিম কের বলেন, “অনেকেই এই গল্পটি জানতে চান। যদি আমরা এটি না করতাম, তবে অন্য কেউ করত।
শুরুতে বিষয়টি আমার কাছে একটু কঠিন লেগেছিল, কারণ অল্প বয়সের একজন পরিচালক হয়েও তারা ব্যান্ডের শুরুর দিনগুলো, গ্লাসগোতে বেড়ে ওঠা, স্বপ্ন দেখা এবং সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার বিষয়টি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সেই সময়ে উত্থান-পতন—সবকিছুই তারা ছবিতে দেখিয়েছেন। এটা আমাদের ভালো লেগেছে।”
তথ্যচিত্রে বব গেলডফ, মলি রিংলা এবং ডেপেচে মোড-এর ডেভিড গাহানের ভাষ্যও রয়েছে।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে যখন পাঙ্ক-রকের জোয়ার আসে, সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে, যা জিম কের এবং গিটারিস্ট চার্লি বার্চিলের প্রথম ব্যান্ড ‘জনি অ্যান্ড দ্য সেলফ অ্যাবিউজার্স’ এবং পরবর্তীতে সিম্পল মাইন্ডস-এর দিকে মোড় নেয়।
জিম কের আরও বলেন, “প্রথম শো থেকেই আমরা জানিয়েছিলাম, আমরা একটি দারুণ লাইভ ব্যান্ড হতে চাই। আমরা সারা বিশ্বে গান করতে চেয়েছিলাম।
এটি আমাদের জীবনের একটি বড় উদ্দেশ্য দিয়েছে।”
ব্যান্ডের প্রথম চারটি অ্যালবাম পোস্ট-পাঙ্ক এবং আর্ট-রকের মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে তারা ইউকে-র চার্টগুলোতে উপরের দিকে উঠতে থাকে।
১৯৮২ সালে তাদের অ্যালবাম ‘নিউ গোল্ড ড্রিম (৮১/৮২/৮৩/৮৪)’ তাদের সাফল্য এনে দেয়।
জিম বলেন, “আমরা আমাদের সঙ্গীতের মিশ্রণটা ঠিক করেছিলাম। আমরা আমাদের সব ধরনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছি।
একসময় নিজেদের মতো করে কিছু তৈরি করতে হয়। আমরাও তাই করেছি। আমাদের প্রভাব থেকে এমন কিছু তৈরি করতে চেয়েছি, যা সিম্পল মাইন্ডস-এর নিজস্ব শব্দ তৈরি করবে।
আমার মনে হয় ‘নিউ গোল্ড ড্রিম’ সেই কাজটি করেছে।”
সিম্পল মাইন্ডস যখন যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপে সফল, তখন আমেরিকায় তাদের পরিচিতি পাওয়া কঠিন ছিল।
‘ডোন্ট ইউ (ফরগেট অ্যাবাউট মি)’ সেই পরিস্থিতি বদলে দেয়। প্রযোজক ও গীতিকার ফরসে শুধু চাননি, তাদের আমেরিকান রেকর্ড লেবেলও চেয়েছিল ব্যান্ডটি এই গানটি করুক।
জিম বলেন, “তারা আমাদের বলেছিল, ‘এই গানটি তোমাদের জন্য দারুণ হতে পারে’। আমরা রাজি হলাম।
তারা গানটি পাঠাল। আমরা বললাম, ‘আরে, গানটা আবার কী? আমরা তো নিজেদের গান লিখি’।
তারা বলল, ‘না, না, এটা একটি সিনেমার জন্য লেখা হয়েছে’। প্রথমে আমাদের ভালো লাগেনি।
গানটি অনেকটা সাইকেডেলিক ফিউরসের মতো শোনাচ্ছিল। আমরা তখন আমাদের পরবর্তী অ্যালবাম ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’-এর কাজ করছিলাম, যা আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করছিল।
আমরা তাদের বললাম, আমাদের গানগুলোর মধ্যে থেকে একটি নিতে পারেন। কিন্তু তারা শোনেনি। পরে সিনেমার পরিচালক জন হিউজের সঙ্গে কথা বলার পর আমাদের সব দ্বিধা দূর হয়ে যায়।
আমরা রাজি হয়ে গেলাম।”
গানটি নিয়ে কাজ করার জন্য তারা একদিনে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। জিম বলেন, “আমরা গানটিকে সিম্পল মাইন্ডস-এর মতো করে তৈরি করি।
আমরা ‘লা-লা-লা-লা’ যুক্ত করি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাজটি শেষ হয়ে যায়।
আমরা সবাই তখন বলছিলাম, জানি না, কী তৈরি হল, তবে ভালো লাগছে।”
১৯৮৫ সালটি সিম্পল মাইন্ডস-এর জন্য দারুণ ছিল। ওই বছর ‘ডোন্ট ইউ (ফরগেট অ্যাবাউট মি)’ এবং ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ অ্যালবামটি মুক্তি পায়।
অ্যালবামটিতে ‘এলাইভ অ্যান্ড কিকিং’ এবং ‘স্যান্টিফাই ইয়োরসেলফ’-এর মতো হিট গান ছিল।
এছাড়াও, ব্যান্ডটি লাইভ এইডে অংশ নেয়, যা তথ্যচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
জিম বলেন, “সেদিন অনেক বড় বড় শিল্পী ছিলেন এবং আমরা সেখানে গান করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এত বড় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমরা সম্মানিত বোধ করি।”
‘ওয়ান্স আপন আ টাইম’ সফরের পর সিম্পল মাইন্ডস-এর সঙ্গীত আরও গভীর এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে, যা ১৯৮৯ সালের ‘স্ট্রিট ফাইটিং ইয়ার্স’ অ্যালবামে দেখা যায়।
জিম বলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে, যখন আপনি বড় হন, বিশ্বকে দেখেন, ভ্রমণ করেন, তখন আপনার মনে হয়, বিশ্বের বড় বিষয়গুলো আপনার সঙ্গীতে তুলে ধরা উচিত।”
তথ্যচিত্রে ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে ব্যান্ডের সদস্য পরিবর্তন, ম্যানেজারের প্রস্থান এবং সঙ্গীতের পরিবর্তনের কারণে কঠিন সময়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে।
এমন একটা সময় ছিল, যখন জিম প্রায় ব্যান্ড ভেঙে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
জিম বলেন, “চার্লি এবং আমি যখন এ বিষয়ে কথা বলি, চার্লি সবসময় বলে, ‘না’। আর আমি বলি, ‘আমি তো একবার ভেবেছিলাম’।
চার্লি তখন বলে, ‘হ্যাঁ, তবে কয়েকদিনের জন্য’। কঠিন সময় ছিল, কোনো সন্দেহ নেই।
যখন নতুন প্রজন্ম আসে, তখন তারা পুরনোদের ভালোভাবে নিতে চায় না। তাদের সময় শেষ হয়ে গেছে—এমনটা তারা মনে করে।
এই সময়ে আপনারা কী করবেন? হয় হতাশ হয়ে বসে থাকবেন, না হয় পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করবেন?”
জিম এবং চার্লি দুজনেই তাদের জীবনের অন্য দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। চার্লি তার সন্তানদের বড় করছিলেন।
জিম তার প্রাক্তন স্ত্রী ক্রিসি হাইন্ডের সঙ্গে দুটি সন্তানের দেখাশোনা করছিলেন।
জিম আরও বলেন, “খুব দ্রুতই আবার ফোন আসতে শুরু করল। অস্ট্রেলিয়ায় একটি উৎসবে গান করার প্রস্তাব এল, জাপান থেকে সফরের প্রস্তাব এল।
নতুন প্রজন্ম সবকিছু অন্যভাবে দেখে।
ইন্টারনেট আসার কারণে সরাসরি শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ হয়েছে।
হয়তো মিডিয়া আপনাকে নিয়ে লিখতে আগ্রহী নয়, তবে যারা আগ্রহী, তাদের সঙ্গে আপনি সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।”
সিম্পল মাইন্ডস তাদের সাম্প্রতিক অ্যালবামগুলোতে নতুন শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে দারুণ সাফল্য পেয়েছে।
তাদের বর্তমান ‘এলাইভ অ্যান্ড কিকিং’ সফরটিও দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
জিম বলেন, “বিশেষ করে আমেরিকাতে, আমরা এখনো অনেক কিছু প্রমাণ করতে চাই। আমাদের এখনো অনেক কিছু করার আছে।”
জিম বলেছেন, এমন একটা সময় আসবে, যখন সিম্পল মাইন্ডস-কে বিদায় জানাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা যা করছি, ভালোবাসি।
তাহলে কেন আমরা এটা ছেড়ে দেব?
তবে এটা অনেক বেশি কঠিন।
পরিবারকে সময় দেওয়া যায় না।
এমন একটা সময় আসবে, যখন মনে হবে, যথেষ্ট হয়েছে।
হয়তো খুব শীঘ্রই আমরা আমাদের ভক্তদের বলব, ‘এই যাত্রাটা অসাধারণ ছিল।
আমরা আরও একবার আসব এবং আপনাদের বিদায় জানানোর সুযোগ দেব।’
আমরা কোনো কিছু শেষ করার আগে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলব।”
সিম্পল মাইন্ডস: এভরিথিং ইজ পসিবল’ সিনেমাটি এখন বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে।
তথ্য সূত্র: পিপল