সিঙ্গাপুরের সবুজ রঙের ‘পান্ডান’ কেক এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এই কেক তৈরি এবং বাজারজাত করার ক্ষেত্রে একটি পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। সুস্বাদু এই কেকের গল্প এখন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা।
সিঙ্গাপুরে বসবাসকারীদের কাছে পান্ডান কেক একটি অতি পরিচিত নাম। হালকা সবুজ রঙের এই স্পঞ্জি কেকটি সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে কাজের পথে অথবা বন্ধুদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রায়ই এই কেকের দেখা মেলে। এই কেকের মূল উপাদান হলো ‘পান্ডান’ নামক এক প্রকার পাতা।
এই পাতা থেকেই কেকের সবুজ রং এবং হালকা ভ্যানিলার স্বাদ আসে। ধারণা করা হয়, ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপপুঞ্জে এর জন্ম।
সিঙ্গাপুরের খাদ্য ইতিহাসবিদ খির জোহারি বলেন, ১৯৭০-এর দশকে প্রথম পান্ডান কেকের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমানে এটি শহরটির প্রতিটি কোণায়, ছোট বেকারি থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁ পর্যন্ত সব জায়গাতেই বিদ্যমান। এই কেকটিকে শহরজুড়ে পরিচিত করতে একটি পরিবারের মালিকানাধীন বেকারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বেঙ্গাওয়ান সোলো নামের একটি বেকারি ১৯৭৯ সালে প্রথম এই কেক তৈরি শুরু করে। বেকারির প্রতিষ্ঠাতা আনাস্তাসিয়া লিউ বলেন, “আমিই সিঙ্গাপুরে এটিকে জনপ্রিয় করেছি।” তাঁর ছেলে, কোম্পানির পরিচালক হেনরি লিউ যোগ করেন, “আমরা খুব বিনয়ী নই।” প্রথমে আনাস্তাসিয়া বাড়িতে কেক তৈরি করে বিক্রি করতেন।
পরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে বিক্রি করার জন্য লাইসেন্স পেতে একটি দোকান খোলেন। বর্তমানে বেঙ্গাওয়ান সোলোর ৬০ লক্ষ মানুষের শহরটিতে ৪০টির বেশি দোকান রয়েছে।
হেনরি লিউ জানান, তাঁদের বেকারির জনপ্রিয়তার পেছনে মুখ-প্রচার এবং কিছু সেলিব্রিটির সমর্থনও ছিল। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় শিল্পী জে জে লিন আট বছর আগে একটি চীনা গানের অনুষ্ঠানে বিচারকদের পান্ডান কেক উপহার দিয়েছিলেন। ২০২২ সালে তাইওয়ানের সঙ্গীত তারকা জে চাউ সিঙ্গাপুরে পারফর্ম করার সময় কেকগুলো উপহার হিসেবে পান এবং সে কথা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন।
বেঙ্গাওয়ান সোলো কেকের পাশাপাশি ‘কুয়েহ ল্যাপিস’ (স্তরযুক্ত কেক), ‘ওন্দেহ ওন্দেহ’ (খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি) এবং আনারসের টার্টের মতো বিভিন্ন পণ্যও বিক্রি করে। তবে তাদের সবচেয়ে পরিচিত পণ্য হলো পান্ডান চেরিফন কেক।
গত বছর বেকারিটি প্রায় ৮৫,০০০টি পুরো পান্ডান চেরিফন কেক বিক্রি করেছে, যার প্রতিটির দাম ছিল ২২ সিঙ্গাপুর ডলার (প্রায় ১,৭০০ টাকা)। এই সময়ে তাদের ব্যবসার আয় ছিল প্রায় ৭৬ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার (প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বেশি)। ২০২৩ সালের তুলনায় এই আয় ১১ শতাংশ বেশি ছিল।
তবে তাদের ব্যবসার সবচেয়ে বড় সুযোগ সম্ভবত দেশের বাইরে।
হেনরি লিউ বলেন, “আমার মনে হয় সিঙ্গাপুরে আমরা খুব বেশি প্রসারিত হতে পারব না।” তিনি আরও জানান, কোম্পানিটি এশিয়া এবং সম্ভবত আরও দূরে, খাদ্য উপহার হিসেবে তাদের পণ্য বিক্রির দিকে মনোযোগ দিতে চাইছে।
এর জন্য তারা আকর্ষণীয় প্যাকেজিংয়ের ওপর কাজ করছে। “এশীয় অঞ্চলে উপহার দেওয়ার সংস্কৃতি বেশ শক্তিশালী,” তিনি যোগ করেন।
বর্তমানে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেঙ্গাওয়ান সোলোর পাঁচটি দোকান রয়েছে। এই বিমানবন্দরটি বিশ্বের চতুর্থ ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এখানকার দোকানগুলো থেকে ভালো বিক্রি হয়, বিশেষ করে হংকং, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান থেকে আসা ভ্রমণকারীদের মধ্যে এই কেকের চাহিদা বেশি।
হেনরি জানান, তাঁরা বিদেশে ব্যবসার প্রসারের কথা ভাবছেন। তবে হংকং-এর মতো কিছু জায়গায় বেশি ভাড়ার কারণে তাঁদের সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখতেও সচেষ্ট।
বর্তমানে তাঁরা বেশিরভাগ স্থানীয় উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন এবং মালয়েশিয়া থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোগ্রাম পান্ডান পাতা আনেন।
বেঙ্গাওয়ান সোলোর বাইরেও, পান্ডান-এর জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। হংকং-এ ‘পান্ডান ম্যান’ নামের একটি বেকারি এই কেক বিক্রি করছে। নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো এবং লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরগুলোতে পান্ডান ফ্লেভারের বিভিন্ন খাবার, যেমন—মোচি এগ টার্ট এবং ক্রনুট-এর চাহিদাও বাড়ছে।
নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক কেরি ম্যাটউইক বলেন, বর্তমানে আমেরিকাতে এশীয় বেকিং-এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে, মাচা, নারকেল এবং উবে (ফিলিপাইনের বেগুনী আলু) দিয়ে তৈরি ডেজার্টগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। জাপানি সবুজ চা ‘মাচা’ এখন এতটাই জনপ্রিয় যে, সেখানকার কিছু চা বিক্রেতা এর স্বল্পতা নিয়ে সতর্ক করেছেন।
বর্তমানে পান্ডানের বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ম্যাটউইক বলেন, “মাচা ইতিমধ্যেই সবুজ রঙের খাবারের ধারণা দিয়েছে। আমার মনে হয়, পান্ডান আগের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হবে।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন