কম ঘুম? বেশি ঘুম? হৃদরোগের ভয়ঙ্কর বিপদ!

হৃদরোগের ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে ঘুমের অভাব বা আধিক্যও অন্যতম। সম্প্রতি গবেষণা বলছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বা অতিরিক্ত ঘুমালেও হৃদরোগের সম্ভবনা বাড়ে।

শুধু তাই নয়, যাদের হৃদরোগের জিনগত ঝুঁকি রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে সঠিক ঘুমের পরিমাণ হৃদরোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই ভালো ঘুমের উপকারিতা নিয়ে কথা বলেছেন। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মনকে শান্ত করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।

এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, খেলাধুলার পারফরম্যান্স এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের এক তৃতীয়াংশই পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হন। নতুন গবেষণা বলছে, খুব কম ঘুমালে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমালেও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।

এমনকি যারা শারীরিকভাবে সুস্থ, তাদেরও এই ঝুঁকি থাকে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যাদের হৃদরোগের জিনগত প্রবণতা রয়েছে, তাদের জন্য প্রতিদিন ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডারের ইন্টিগ্রেটিভ ফিজিওলজির সহকারী অধ্যাপক সেলিন ভেট্টার জানান, “আমরা যদি জীবনযাত্রাকে আরও উন্নত করতে চাই, তাহলে ঘুমের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

আমাদের গবেষণা বলছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া অথবা অতিরিক্ত ঘুমানো হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। সবার জন্যই এটি প্রযোজ্য, তাদের ঝুঁকির মাত্রা যা-ই হোক না কেন।”

২০১৮ সালের একটি গবেষণায় ৬০,০০০ এর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের উপর সমীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায়, যারা প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার কম ঘুমোন, তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

ঘুমের গুণগত মান খারাপ হলেও, যেমন ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখা বা সহজে ঘুম না আসা, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও, যারা ৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সামান্য ঝুঁকি বাড়লেও, এই সম্পর্কটি পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না।

অন্যদিকে, প্রায় ৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের উপর করা একটি মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অতিরিক্ত ঘুমের কারণে করোনারি হৃদরোগ, হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। এই গবেষণাটি দেখায় যে, ঘুমের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ে।

এই দুটি গবেষণা ঘুমের পরিমাণ এবং গুণগত মান—উভয়ের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া অথবা অতিরিক্ত ঘুম—উভয়ই হৃদরোগের কারণ হতে পারে।

আমরা এখনো জানি না ঘুমের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি কীভাবে কমে, তবে এটা জানা যে, সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থ জীবনের জন্য ঘুম অপরিহার্য।

ঘুমের ভালো অভ্যাস কর্মক্ষমতা, মেজাজ, শেখা এবং স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটায়। অন্যদিকে, ঘুমের অভাব শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং হৃদরোগের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

ইয়েল মেডিসিনের ঘুম বিশেষজ্ঞ এবং পালমোনোলজিস্ট ড. মেইর ক্রাইগার বলেন, “পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বিপাকীয় সমস্যা (যেমন: স্থূলতা), প্রদাহ, মানসিক চাপ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তন এবং রক্তনালীর স্বাভাবিক কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

যারা ইতিমধ্যেই হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি হৃদরোগের আক্রমণ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।”

সুতরাং, যাদের হৃদরোগের জিনগত ঝুঁকি রয়েছে, তাদের জন্য ঘুমের প্রতি মনোযোগ দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের সমস্যা হলে কী করবেন?

সবার পক্ষে সহজে ঘুমোতে যাওয়া সম্ভব হয় না। কেউ উদ্বেগ বা অনিদ্রা (Insomnia) রোগে ভোগেন, আবার কারও ঘুমের সমস্যা হয় বয়স অথবা নবজাতকের কারণে।

ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হতে পারে এবং বিদ্যমান রোগগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে, বিশেষ করে হৃদরোগের ক্ষেত্রে।

নর্থওয়েল হেলথের নর্থ শোর ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের কার্ডিওলজির পরিচালক ডা. গাই মিনজ বলেন, “হৃদয় একটি মোটর, যা দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করে।

একটি গাড়ির ইঞ্জিনের মতো, এরও বিশ্রাম প্রয়োজন। একটানা চললে যেমন ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়, তেমনি ঘুমের অভাব হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।”

কারও হয়তো ৬ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট, আবার কারও ৯ ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে। যাদের ঘুমের সমস্যা আছে, তাদের একজন ঘুম বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

তারা ঘুমের কারণ খুঁজে বের করতে এবং প্রতিকারের উপায় বা`তলাতে পারেন।

উদাহরণস্বরূপ, জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (Cognitive Behavioral Therapy) অনিদ্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে। ভেট্টার আরও বলেন, জীবনযাত্রার ধরন এবং ব্যায়াম, ক্যাফিন, খাবার ও অ্যালকোহল গ্রহণের সময়ও ঘুমের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ একটি ঘুমের জার্নাল (Sleep Journal) রাখার পরামর্শ দেন, যেখানে একজন ব্যক্তি তার ঘুমের ধরণ লিপিবদ্ধ করেন। এটি ঘুমের অভ্যাস এবং ঘুমের কারণগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করতে পারে, যা একজন ব্যক্তিকে প্রতিদিন ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমাতে বাধা দেয়।

সবশেষে, হৃদরোগের ঝুঁকি থাকুক বা না থাকুক, সবারই ঘুমের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ড. মিনজ বলেন, “যেকোনো বয়সেই পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন।”

গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের অভাব, অতিরিক্ত ঘুম এবং ঘুমের খারাপ গুণগত মান—এগুলো সবই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই হৃদরোগ থেকে বাঁচতে হলে ঘুমের পরিমাণ এবং গুণগত মান—উভয়ের দিকেই নজর রাখা জরুরি।

সাধারণত, প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো হৃদরোগ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সহায়ক।

তথ্য সূত্র: হেলথলাইন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *