যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন তৈরির চেষ্টা: কেন কঠিন ছিল, আর এখন কী পরিস্থিতি?
গত এক দশকে, প্রযুক্তি বিশ্বে নিজেদের জায়গা আরও শক্ত করতে চেয়েছিল মটোরোলা। তারা ‘মেড ইন ইউএসএ’ স্লোগান দিয়ে স্মার্টফোন বাজারে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ হিসেবে তারা শ্রমিক পাওয়া এবং তাদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করেছেন মটোরোলার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেনিস উডসাইড।
ডেনিস উডসাইড বর্তমানে এন্টারপ্রাইজ সফটওয়্যার পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রেশওয়ার্কসের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, “তখনকার সময়ে এমন কিছু গ্রাহক ছিলেন যারা বলতেন, ‘যদি তোমরা যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য তৈরি করো, তাহলে আমরা তা বিবেচনা করতে পারি।”
২০১৩ সালে মটোরোলা টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থে তাদের ফ্ল্যাগশিপ ফোন মটো এক্স তৈরি করা শুরু করে। কিন্তু পরের বছরই তারা সেই কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এর মূল কারণ ছিল স্মার্টফোন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বেশি উৎপাদন খরচ।
উডসাইডের অভিজ্ঞতা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অ্যাপল এবং স্যামসাংকে তাদের মোবাইল ডিভাইসগুলো যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করতে চাপ দিচ্ছেন। চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোরও প্রস্তাব ছিল, যা আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
যদিও পরে কোনো সমঝোতা বা সময়সীমা বাড়ানোর মাধ্যমে হয়তো তা এড়ানো যেতে পারে। একই সময়ে, ভারত, যারা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে, তাদেরও ২৫ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে।
উডসাইড বলছেন, কোনো কোম্পানি যদি এখন আমেরিকায় স্মার্টফোন তৈরি করতে চায়, তাহলে তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে উপযুক্ত এবং দক্ষ কর্মী খুঁজে বের করা এবং তাদের ধরে রাখা। কর্মীদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ তৈরি করতে হবে।
সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচ কম রাখার জন্য অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যের দাম প্রতিযোগিতামূলক রাখতে হবে।
মটো এক্স-এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হওয়া ফোনগুলো টেক্সাসে তৈরি হলেও, এর ব্যাটারি, স্ক্রিন এবং মাদারবোর্ড-এর মতো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা হতো এশিয়া থেকে। যদিও গ্রাহকদের কাছে ফোনটির কিছু বিশেষত্ব ছিল, যেমন—ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ফোনের বোতাম এবং পেছনের প্যানেলের রং পরিবর্তন করতে পারতেন।
কিন্তু পর্যাপ্ত বিক্রি না হওয়ায় ২০১৪ সালের মধ্যে মটোরোলা কারখানাটি বন্ধ করে দেয়।
উডসাইডের মতে, “উৎপাদন খরচ বেশি ছিল, যা একটি সমস্যা ছিল। এছাড়াও, সরবরাহ শৃঙ্খল ছিল বেশ জটিল।”
যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন তৈরির ক্ষেত্রে মটোরোলার এই চেষ্টা সম্ভবত একমাত্র বড় ধরনের উদ্যোগ ছিল। যদিও ‘পুরিজম’ নামে একটি স্টার্টআপ কোম্পানি তাদের ‘লিবার্টি ফোন’ তৈরি করে, তবে তারা মটোরোলার মতো এত বেশি সংখ্যায় ফোন তৈরি করে না। টেক্সাসের কারখানায় মটোরোলা প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক লাখ ফোন তৈরি করত।
উডসাইড আরও জানান, কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের ধরে রাখা কঠিন ছিল। কারণ, কর্মীদের কাছে অন্য অনেক বিকল্প ছিল, যেমন—খুচরা ব্যবসা বা খাদ্য পরিষেবা খাতে কাজ করা। এছাড়া, স্মার্টফোন তৈরির কাজটিও বেশ জটিল ছিল। ফোনের যন্ত্রাংশগুলো খুবই ছোট এবং তাদের একত্র করা একটি কঠিন কাজ।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে কারখানার চাকরি পাওয়া এবং প্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাব একটি বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যে দেশটির উৎপাদন খাতে প্রায় ১১ হাজার চাকরি কমেছে।
অন্যদিকে, চীনে স্মার্টফোন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের কোনো অভাব নেই। দেশটির উৎপাদন খাতে প্রচুর লোক কাজ করে। চীনের পঞ্চম অর্থনৈতিক আদমশুমারি অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ১২ কোটি ৩০ লাখ শ্রমিক উৎপাদন খাতে কাজ করেছেন। অ্যাপলের প্রধান সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফক্সকনের ঝেংঝোউ কারখানায় প্রতি মিনিটে প্রায় ৩৫০টি আইফোন তৈরি হতো।
অ্যাপল বর্তমানে চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে ভারত এবং ভিয়েতনামে উৎপাদন শুরু করেছে। এর ফলে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্মার্টফোন রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
স্মার্টফোন তৈরির জন্য চীনের কর্মীর দক্ষতা কেমন, সে বিষয়ে বলতে গিয়ে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক ২০১৭ সালে বলেছিলেন, চীন ‘কারিগর’ দক্ষতা, অত্যাধুনিক রোবোটিক্স এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি দারুণ সমন্বয় তৈরি করেছে।
উডসাইডের মতে, স্মার্টফোন অ্যাসেম্বলিং বা একত্রিত করার কাজটি হলো ক্যামেরার যন্ত্রাংশ এবং চিপের মতো ছোট ছোট উপাদান ফোনের সঙ্গে যুক্ত করা। এই কাজটি সারাদিন ধরে করতে প্রচুর দক্ষতার প্রয়োজন হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত নয়। তাই সেখানে দক্ষ কর্মী তৈরি করা কঠিন। নতুন প্রযুক্তির কারণে কারখানায় কোডিং এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো নতুন দক্ষতারও প্রয়োজন হচ্ছে।
উডসাইড তাই সতর্ক করে বলেছেন, যারা যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরির কথা ভাবছেন, তাদের কর্মীদের দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন