স্মৃতি: একজনের সব মনে, অন্যজনের কিছুই না!

স্মৃতি : সবকিছু মনে রাখা, নাকি কিছুই না মনে রাখা?

স্মৃতি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত, ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা, হাসি-কান্না—সব কিছুই স্মৃতির পাতায় জমা হয়। কিন্তু এই স্মৃতিশক্তি সবার ক্ষেত্রে কি একই রকম থাকে?

কারো কারো স্মৃতি যেন এক চলমান চলচ্চিত্র, যেখানে জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘটনা স্পষ্ট ভাবে ধরা থাকে। আবার কারো স্মৃতি এত দুর্বল যে, কিছুক্ষণ আগের ঘটনাও তারা মনে রাখতে পারেন না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে স্মৃতিশক্তির এই দুই চরম রূপের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার এ.জে. (ছদ্মনাম) নামক ৪১ বছর বয়সী এক নারীর কথা ভাবুন। তিনি ১১ বছর বয়স থেকে তার জীবনের প্রায় প্রতিটি দিন মনে রাখতে পারেন। কোনো ঘটনার তারিখ, সময়, এমনকি সেই দিনের আবহাওয়া পর্যন্ত তার মনে আছে।

১৯৮৬ সালের ৩রা আগস্ট, দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে, তার পছন্দের একজন তাকে ফোন করেছিল—এ তথ্যও তার স্মৃতিতে অম্লান। অন্যদিকে, ই.পি. (ছদ্মনাম) নামের ৮৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি, যিনি পেশায় ছিলেন ল্যাব টেকনিশিয়ান, তার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। তিনি কেবল তার সাম্প্রতিক চিন্তাগুলো মনে রাখতে পারেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ.জে.-র এই বিরল অবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হাইপারথাইমেস্টিক সিনড্রোম’। তার স্মৃতি এতটাই অসাধারণ যে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার স্নায়ু বিজ্ঞানীরা (neuroscientists) এই অবস্থা বর্ণনা করার জন্য নতুন একটি শব্দ তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অন্যদিকে, ই.পি.-র মস্তিষ্কে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্মৃতিশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মস্তিষ্কের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি নতুন কোনো স্মৃতি তৈরি করতে পারেন না। এমনকি ১৯৬০ সালের আগের কোনো ঘটনাও তার মনে নেই।

স্মৃতি আসলে কী? বিজ্ঞানীরা এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, এটি হলো মস্তিষ্কের নিউরনের (neuron) মধ্যে সংযোগের একটি সংরক্ষিত প্যাটার্ন। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে এবং প্রতিটি নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে প্রায় ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ সিনাপটিক সংযোগ তৈরি করতে পারে।

এই বিশাল নেটওয়ার্কের মধ্যে সংযোগের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমেই স্মৃতি তৈরি হয়। প্রতিটি অনুভূতি, চিন্তা—সবকিছুই এই সংযোগগুলোতে পরিবর্তন আনে।

ই.পি.-র ক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের যে অংশে স্মৃতি তৈরি হয়, সেই হিপোক্যাম্পাস (hippocampus) ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি নতুন স্মৃতি তৈরি করতে পারেন না। তার অ্যামনেশিয়া (amnesia) বা স্মৃতিভ্রংশতার কারণে তিনি বর্তমানের বাইরে কিছুই অনুভব করতে পারেন না।

তার জগৎটা যেন বর্তমানের একটি সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ।

স্মৃতিশক্তির এই দুই চরম রূপ—সবকিছু মনে রাখা এবং কিছুই মনে না রাখা—আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্মৃতিই আমাদের পরিচয় গড়ে তোলে। তবে, আমাদের মধ্যে অনেকেই এ.জে.-র মতো সবকিছু মনে রাখার আকাঙ্ক্ষা করি, আবার ই.পি.-র মতো পরিস্থিতিকে ভয় পাই।

স্মৃতি নিয়ে গবেষণা আমাদের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর দেয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্মৃতি দুই ধরনের— ডিক্লারেটিভ (declarative) এবং নন-ডিক্লারেটিভ (non-declarative)। ডিক্লারেটিভ স্মৃতি হলো সেই স্মৃতিগুলো, যা আমরা সচেতনভাবে মনে করি, যেমন—আজকের আবহাওয়া কেমন ছিল, বা আপনার গাড়ির রং কী।

আর নন-ডিক্লারেটিভ স্মৃতি হলো সেইগুলো, যা আমরা অজান্তেই শিখে যাই, যেমন—সাইকেল চালানো বা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো।

স্মৃতির এই জটিল জগৎ আমাদের বিস্মিত করে। আমরা চাই স্মৃতি যেন আমাদের জীবনের সব ভালো দিক ধরে রাখে, খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো ভুলে যাই। কিন্তু বাস্তবে, স্মৃতি সব সময় আমাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে না।

অনেক সময় আমরা প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যাই, আবার অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই মনে রাখি।

স্মৃতি মানুষের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? এ.জে.-র জীবন হয়তো আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়। একদিকে, তার অসাধারণ স্মৃতি তাকে অনেক জ্ঞান দিয়েছে, তবে এর সঙ্গে আছে অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো মনে রাখার যন্ত্রণা।

বর্তমানে স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য ওষুধ তৈরির চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের ওষুধ ভবিষ্যতে আমাদের সমাজ এবং জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। তবে, এর নৈতিক দিকগুলোও বিবেচনা করা জরুরি।

অতএব, স্মৃতি—যা আমাদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে—তা বোঝা সহজ নয়। এটি একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং জটিল। এটি জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, যা আমাদের অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধিকে সংজ্ঞায়িত করে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *