স্মৃতি ও কল্পনার জগৎ: মস্তিষ্কের অজানা পথে যাত্রা!

স্মৃতি: অতীত, ভবিষ্যৎ আর মস্তিষ্কের এক অবিচ্ছেদ্য জগৎ

আমাদের মস্তিষ্ক কি শুধুই অতীতের স্মৃতিগুলো জমা করে রাখার একটা ভাণ্ডার? নাকি এর থেকেও অনেক বেশি কিছু? সম্প্রতি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল শ্যাকটার স্মৃতি নিয়ে এক নতুন ধারণা দিয়েছেন।

তাঁর গবেষণা বলছে, স্মৃতি শুধু অতীতের সাক্ষী নয়, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ কল্পনারও মূল ভিত্তি।

ড্যানিয়েল শ্যাকটারের মতে, আমাদের মস্তিষ্ক অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াকে তিনি ‘গঠনমূলক এপিসোডিক সিমুলেশন’ (Constructive Episodic Simulation) বলছেন।

‘এপিসোডিক’ স্মৃতি হলো আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতি, যা আমরা মনে করি, আর ‘সিমেন্টিক’ স্মৃতি হলো তথ্য এবং ধারণাগত স্মৃতি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, স্মৃতি যেন আমাদের মস্তিষ্কের খেলনা, যা দিয়ে আমরা ভবিষ্যতের ছবি আঁকি।

শ্যাকটারের গবেষণার মূল বিষয় হলো, স্মৃতি কীভাবে কাজ করে এবং এর ভুলগুলো কীভাবে হয়। তিনি ‘স্মৃতির সাতটি পাপ’ (Seven Sins of Memory) নামে একটি ধারণা দিয়েছেন, যেখানে স্মৃতি বিভ্রমের বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যেমন, কোনো ঘটনার বিস্তারিত মনে রাখতে না পারা, অথবা নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করার জন্য স্মৃতিকে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা ইত্যাদি।

তাঁর গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অতীতের স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের কল্পনার মধ্যেকার সম্পর্ক। মস্তিষ্কের যে অংশগুলো অতীতকে মনে রাখতে সাহায্য করে, সেগুলোই ভবিষ্যৎকে কল্পনা করতেও কাজে লাগে।

একটি ঘটনার কথা চিন্তা করুন, যখন কোনো পরিচিত ব্যক্তির নাম মনে করতে গিয়ে আপনি হিমশিম খাচ্ছেন। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আসলে স্মৃতির জটিলতারই অংশ।

ড্যানিয়েল শ্যাকটার তাঁর গবেষণায় একটি বিশেষ রোগীর কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁর স্মৃতিশক্তির গুরুতর সমস্যা ছিল। কেসি (K.C.) নামের সেই রোগীর মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে অতীতের কোনো ঘটনা মনে করার ক্ষমতা ছিল না।

কিন্তু মজার বিষয় হলো, তিনি স্বাভাবিকভাবে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। এই ঘটনাটি শ্যাকটারকে স্মৃতি এবং কল্পনার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিল।

গবেষণায় দেখা গেছে, অতীতের স্মৃতিগুলো একত্রিত করে আমরা ভবিষ্যতের জন্য নতুন পরিস্থিতি তৈরি করি। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি নতুন রেস্তোরাঁয় খেতে যান, তবে আপনার অতীতের খাবারের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগবে।

আপনি সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেবেন, কী খাবেন বা কীভাবে পরিবেশটা উপভোগ করবেন।

বর্তমান ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তির কারণে আমাদের স্মৃতি অনেকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে পাওয়া ছবি বা তথ্যগুলো আমাদের স্মৃতিকে নতুন রূপে সাজাতে পারে।

অনেক সময়, আমরা না চাইলেও অতীতের কোনো ঘটনা আমাদের সামনে এসে হাজির হয়, যা হয়তো আমাদের স্মৃতিকে নতুনভাবে প্রভাবিত করে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – এআই) নিয়ে কাজ করতে গিয়েও শ্যাকটার স্মৃতি এবং এর জটিলতা সম্পর্কে নতুন ধারণা পেয়েছেন। এআইয়ের ভাষা মডেলগুলো কীভাবে তথ্য তৈরি করে, তা অনেকটা মানুষের স্মৃতির মতোই।

এআইয়ের ত্রুটিগুলোও আমাদের স্মৃতিবিভ্রমের মতো।

ড্যানিয়েল শ্যাকটারের এই গবেষণা আমাদের স্মৃতি এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। স্মৃতি শুধু অতীতের সাক্ষী নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের পথপ্রদর্শকও বটে।

তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *