মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য এক নতুন দুঃসংবাদ! ছাত্র ঋণের দায়ে জর্জরিত প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার উপর আবার কোপ বসাতে চলেছে সরকার। এর ফলে জীবন ধারণের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বহু প্রবীণ।
একদিকে যখন উন্নত জীবনযাত্রার স্বপ্ন ফিকে হচ্ছে, অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সে এসে দেনার বোঝা যেন আরও ভারী হয়ে উঠছে।
নিউ ইয়র্ক থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, কয়েক দশক আগের ছাত্র ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় কয়েক লক্ষ বয়স্ক আমেরিকান নাগরিক এখন সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার অংশ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে ছাত্র ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছিল, তা ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার পরেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এর ফলে, সরকারের পক্ষ থেকে বেতন, ট্যাক্স রিফান্ড এবং সামাজিক নিরাপত্তা থেকে সরাসরি ঋণ আদায় করার প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ইয়ানেজের বাসিন্দা ৭৩ বছর বয়সী ক্রিস্টিন ফারো এমনই একজন। ছাত্র জীবনের ঋণ শোধ করতে না পারায় এখন তার সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার একটা অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে।
এমনকি, নাতি-নাতনীদের জন্মদিনের উপহার দেওয়া কিংবা পোষ্যদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ যোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। ফারোর কথায়, “আমি একসময় অনেক বেশি সময় কাজ করেছি। সপ্তাহান্তে এবং রাতেও কাজ করেছি। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে পারিনি।”
ফারোর মত কয়েক লক্ষ ঋণগ্রহীতার ছাত্র ঋণের কিস্তি অতিমারীর কারণে কয়েক বছর বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন সেই সুযোগ আর নেই। তিনি জানান, ৪০ বছর আগে তিনি যখন ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন, তখন তিনি একা মা ছিলেন।
সেই সময় ঋণ পরিশোধ করার মতো পর্যাপ্ত আয় তার ছিল না। এরপর তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি নিলেও তার বেতন তেমন বাড়েনি। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় বর্তমানে তার ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫০,০০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকার সমান।
ঋণ পরিশোধের জন্য তিনি যখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন তাকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কনজিউমার ল’ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, বয়স্ক আমেরিকানদের মধ্যে ছাত্র ঋণের বোঝা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বর্তমানে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ছাত্র ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০ বছর আগের তুলনায় ছয় গুণ বেশি।
এর ফলস্বরূপ, যারা সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পান, তাদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের কারণে ভাতার অংশ কেটে নেওয়ার সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে।
কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের জর্জটাউনের বাসিন্দা ৬২ বছর বয়সী ডেবি ম্যাকইনটায়ারও এই সমস্যার শিকার। তিনি শিক্ষকতা করেন এবং অবসর জীবনে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার স্বপ্ন দেখেন।
কিন্তু স্বামীর অক্ষমতার কারণে গত দুই দশক ধরে তাদের সংসার ঋণ করে চলছে। তাদের বাসা ভাড়া বাড়ার কারণে এখন জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ম্যাকইনটায়ার বলেন, “আমি জানি না আর কী করতে পারি। এই অবস্থা থেকে আমার মুক্তি নেই।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে অনেক বয়স্ক নাগরিক খাদ্য ও ওষুধ কেনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন, এমনকি অনেকে গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
সরকার যদিও দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী ঋণগ্রহীতাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার ৭৫০ ডলার পর্যন্ত (প্রায় ৮২,৫০০ টাকা) সুরক্ষিত রেখেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে যখন সরকার মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, ঠিক তখনই আরেক হাত দিয়ে সেই সহায়তা কেড়ে নিচ্ছে।
আরেকজন প্রবীণ নাগরিক, ৭৬ বছর বয়সী লিন্ডা হিলটন, যিনি আগে একবার এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, তিনি মনে করেন এবারও তিনি পরিস্থিতি সামলে নিতে পারবেন।
কিন্তু তিনি আশঙ্কা করছেন, সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া কিংবা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার মতো অবসর জীবনের আনন্দগুলো হয়তো তার জীবনে আর থাকবে না।
বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে। তবে অনেকেই মনে করছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ বয়স্ক নাগরিকদের জীবন আরও কঠিন করে তুলবে।
ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ৫৫ বছর বয়সী র্যান্ডাল কান্ট্রিম্যান বলছেন, ছাত্র ঋণ নিয়ে সরকারের নীতিগুলো বয়স্ক মানুষের জীবনকে কতটা কঠিন করে তোলে, তা অনেকেই জানেন না। তিনি নিজেও একসময় ছাত্র ছিলেন, কিন্তু ঋণের কারণে ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি।
মোটকথা, বয়স্ক নাগরিকদের ছাত্র ঋণের বোঝা একদিকে যেমন তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে, তেমনই তাদের বর্তমান জীবনযাত্রাকেও কঠিন করে তুলেছে।
তথ্যসূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস