সমুদ্রে কার্বন: জলবায়ু পরিবর্তনে নয়া দিগন্ত?

সমুদ্রের গভীরে কার্বন বন্দী: জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় নতুন দিগন্ত?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আজ সারা বিশ্বজুড়ে অনুভূত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি, বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড (Carbon Dioxide) অপসারণের প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে।

আর এই লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা এখন সমুদ্রের দিকে ঝুঁকছেন। সমুদ্রের বিশালতা এবং কার্বন শোষণ করার প্রাকৃতিক ক্ষমতার কারণে, একে কার্বন সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি, বিভিন্ন কোম্পানি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমুদ্রের কার্বন শোষণের নতুন নতুন উপায় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। কানাডার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি কোম্পানি, ‘প্ল্যানেটারি টেকনোলজিস’ (Planetary Technologies), এই ধরনের একটি প্রকল্পের ওপর কাজ করছে।

তারা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের জন্য ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড (Magnesium Oxide) নামক একটি খনিজ পদার্থ ব্যবহার করছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে, কার্বন ডাই অক্সাইডকে স্থিতিশীল অণুতে রূপান্তরিত করে তা সমুদ্রের গভীরে জমা করে রাখা সম্ভব।

তবে, সমুদ্রের মাধ্যমে কার্বন সংরক্ষণের ধারণাটি এখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা বলছেন, এই ধরনের প্রকল্পগুলো পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।

এছাড়াও, এই পদ্ধতিগুলো কতখানি কার্যকর হবে, সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

বর্তমানে, কার্বন ক্রেডিট (Carbon Credit) নামক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন করা হচ্ছে। কার্বন ক্রেডিট হলো, এক টন কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া একটি সনদ।

কোম্পানিগুলো তাদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরাসরি পদক্ষেপ না নিয়ে, এই ক্রেডিট কিনে তাদের দায় সারছে। যদিও এই কার্বন ক্রেডিট ব্যবস্থা এখনো তেমনভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়।

বর্তমানে, সমুদ্র-ভিত্তিক কার্বন অপসারণের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, সমুদ্র শৈবাল (Seaweed) বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা।

এই শৈবালগুলো গাছের মতোই কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। এছাড়াও, কিছু কোম্পানি সমুদ্রের গভীরে কাঠ ও অন্যান্য জৈব পদার্থ জমা করার পরিকল্পনা করছে।

এই প্রকল্পের সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক। তবে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সমুদ্রের বিশালতা এবং গভীরতার কারণে, এখানে কাজ করা বেশ কঠিন।

এছাড়া, সমুদ্রের পানিতে যোগ করা উপাদানগুলো অন্য স্থানে ছড়িয়ে যেতে পারে। ফলে, এর সঠিক হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সমুদ্র-ভিত্তিক কার্বন সংরক্ষণের ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এর কার্যকারিতা এবং পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং পরিবেশবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের প্রযুক্তি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানকার জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই, সমুদ্রের মাধ্যমে কার্বন সংরক্ষণের ধারণাটি বাস্তবায়িত হলে, তা বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে, এক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস (Associated Press)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *