ছেলের স্মৃতি: ১০ বছর পরেও তিনিই আমার অনুপ্রেরণা, জানালেন লেখক

বাবা হওয়ার আনন্দ-বেদনা: সন্তানের পথ ধরেই লেখকের জন্ম।

ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল সিনেমার চিত্রনাট্যকার হওয়ার, কিন্তু জীবন অন্য পথ বেছে নিয়েছিল। আজ তিনি পরিচিত একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে, যিনি ইতোমধ্যে ১৩টি রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার ও গোয়েন্দা গল্পের বই লিখেছেন।

এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে এক গভীর শোকগাথা, যা সন্তানের অসুস্থতা থেকে জন্ম নিয়েছিল। বলছি, জেমস পন্টি নামের এক লেখকের কথা।

ফ্লোরিডায় বসবাস করা জেমস একসময় শিশুদের জন্য টেলিভিশনে কাজ করতেন। ছেলে অ্যালেক্সের জন্মের পর তাদের পরিবারে আনন্দের ঢেউ লাগে, কিন্তু সেই আনন্দ ধীরে ধীরে উদ্বেগে রূপ নেয়।

অ্যালেক্সের কথা বলতে সমস্যা হতো, খেলনা নিয়ে খেলতে চাইত না, এমনকি নিজের নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দিত না। অনেক পরীক্ষার পরও কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা অটিজমের কথা বললেও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছিলেন না।

অ্যালেক্সের যখন অটিজম ধরা পড়ে, তখন জেমস শিশুদের জন্য লেখালেখি ভালোবাসতে শুরু করেন। ছেলের চিকিৎসার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হতে থাকে।

অ্যালেক্স কথা বলতে পারত না, নিজের মতো করে কিছু প্রকাশও করতে পারত না। কিন্তু পরিবারের ভালোবাসায় সে ছিল খুশি। ছেলের জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন না এনে, জেমস নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য পরিবর্তন করতে রাজি হন।

এরপর তিনি টেলিভিশনের কাজ ছেড়ে দেন এবং কার্টুন লেখা ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম তৈরি করতে শুরু করেন। অ্যালেক্সের দেখাশোনার সুবিধার্থে, তিনি ফ্লোরিডার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ছেলের ভালো থাকার জন্য নিজের কাজকে সবসময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন তিনি।

একদিন, অ্যালেক্স ঘুমের মধ্যে খিঁচুনি হতে শুরু করে। এরপর তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। স্কুলে যাওয়া সত্ত্বেও, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে যেতে থাকে।

অ্যালেক্স যখন ১২ বছরের, তখন জেমস গলফ চ্যানেলে ভালো বেতনের একটি চাকরি পান। এখানে তিনি সময়মতো অফিসের কাজ শেষ করে অ্যালেক্সকে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারতেন। এরপর তার স্ত্রী, যিনি একজন শিক্ষক, তিনিও অ্যালেক্সের দেখাশোনার জন্য সময় বের করতে পারতেন। এভাবেই তারা দুজনে মিলে ছেলের দেখভাল করতেন।

চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে তাদের অনেক সময় আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি ঘর হারানোর উপক্রমও হয়েছিল। গ্রেসন নামের তাদের আরেক ছেলে, সে এখনো জানে না, কীভাবে তারা এত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।

এই কঠিন সময়ে জেমস টুকটাক লেখালেখি শুরু করেন। টেলিভিশনের বিভিন্ন সিরিজের ওপর ভিত্তি করে বাচ্চাদের জন্য বই লিখতেন। এর পাশাপাশি ছদ্মনামে প্রেমের উপন্যাসও লিখেছেন, যা তাদের কিছুটা হলেও আর্থিক সাহায্য করত। লেখালিখি যে তার জীবনে এত বড় পরিবর্তন আনবে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

অ্যালেক্সের যখন ২২ বছর বয়স হয়, তখন তার বিশেষ স্কুলজীবন শেষ হওয়ার উপক্রম হয়। এরপর তার জন্য ২৪ ঘণ্টা দেখাশোনার প্রয়োজন ছিল। কারণ, তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। তারা কোনোভাবেই অ্যালেক্সকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে রাজি ছিলেন না। তাই জেমস সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন এবং ছেলেকে দেখাশোনা করবেন।

ছেলের দেখাশোনার পাশাপাশি রাতে লেখক হওয়ার পরিকল্পনা করেন জেমস। অ্যালেক্সের স্কুলের পার্কিং লটে বসে তিনি একটি বইয়ের আইডিয়া তৈরি করেন, যেখানে বিজ্ঞান স্কুলের এক মেয়ের প্রেম নিয়ে গল্প ছিল। বইটির নাম দেন ‘ডেড সিটি’।

অ্যালেক্স হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন, জেমস তার পাশে বসে প্রথম অধ্যায়টি লেখেন। সেই সময় অ্যালেক্সের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাকে সবসময় নানা যন্ত্রপাতির সঙ্গে জুড়ে রাখা হতো। ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে দিতে তিনি লিখতেন। এভাবেই তিনি তিনটি ‘ডেড সিটি’ বই লেখেন। বইগুলো ভালো বিক্রি হওয়ায় তিনি নতুন একটি জীবন খুঁজে পান।

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি পুরোদমে লেখালেখি করবেন। অ্যালেক্সের দেখাশোনার জন্য একজন স্বাস্থ্যকর্মীও রাখা হলো। ২০১৬ সালে, জেমস যখন চতুর্থ বই ‘ফ্রেমড’ লিখছিলেন, তখন একদিন সকালে অ্যালেক্সকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

ছেলের মৃত্যুর পর তিনি কয়েক মাস লিখতে পারেননি। কিন্তু তার সম্পাদক ফিয়োনার উৎসাহে তিনি ধীরে ধীরে লেখার টেবিলে ফিরে আসেন। অ্যালেক্সকে উৎসর্গ করে তিনি একের পর এক বই লিখতে শুরু করেন। জেমস বুঝতে পারলেন, অ্যালেক্স শুধু তার বইয়ের একটি অংশ নয়, বরং তিনিই তার লেখার অনুপ্রেরণা।

আজও, জেমস যখন হাসপাতালে যান, তখন তিনি সেই সব পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন, যাদের শিশুরা কঠিন রোগের সঙ্গে লড়াই করছে। তাদের মুখে যখন তিনি নিজের বইয়ের কথা শোনেন, তখন তিনি অনুভব করেন, অ্যালেক্স এখনো তাদের পাশে আছে।

জেমসের কাছে অ্যালেক্স সবসময় তার নায়ক এবং পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন।

তথ্য সূত্র: পিপল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *