সন্তান হারানোর পর বাবারা: কষ্টের দিনে আলোর দিশা, একতাবদ্ধ হওয়ার গল্প

শিরোনাম: সন্তান হারানোর বেদনা: পিতাদের আশ্রয়স্থল ‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, পুরুষদের আবেগ প্রকাশের সুযোগ খুব কমই মেলে। সমাজের এই কঠিন বাস্তবতার মাঝে, সন্তান হারানোর গভীর শোক বুকে নিয়ে অসহায় বোধ করা পিতাদের জন্য এক নীরব আশ্রয়স্থল গড়ে উঠেছে।

‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’ নামের এই সংগঠনটি শোকাহত পিতাদের একতা ও মানসিক সহায়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি ১৭৫টি গর্ভধারণের মধ্যে একটি মৃত সন্তান জন্ম নেয়। অর্থাৎ, প্রতি বছর প্রায় ২১,০০০ শিশু জন্মের আগেই মারা যায়।

এই ভয়াবহ ক্ষতির শিকার পিতাদের জন্য উপযুক্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খুবই জরুরি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা একাকীত্বে ভোগেন।

কারণ, শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে পুরুষদের দুর্বল হিসেবে চিত্রিত করার একটি প্রবণতা সমাজে বিদ্যমান।

এই প্রেক্ষাপটে, ‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’ যেন এক আলো ঝলমলে আশ্রয়, যেখানে বাবারা তাঁদের দুঃখ, ভয়, রাগ, দ্বিধা – সবকিছু ভাগ করে নিতে পারেন।

২০১৭ সালে, রব রাইডার, জে তানসি এবং ক্রিস পিয়াসেকি নামের তিন বন্ধু তাঁদের শিশুদের অকাল মৃত্যুতে শোকাহত হন। তাঁরা বুঝতে পারেন, এই গভীর শোকের সময়ে তাঁদের একে অপরের প্রতি সমর্থন প্রয়োজন।

তাঁরা একত্রিত হয়ে নিজেদের দুঃখ ভাগাভাগি করতেন, আলোচনা করতেন এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেন। এই আলোচনার সূত্র ধরেই জন্ম হয় ‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’-এর।

এই ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত অনলাইন ভিডিও কলের মাধ্যমে মিলিত হন। সেখানে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শোকের গভীরতা এবং কিভাবে এই শোকের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন, সেই বিষয়ে আলোচনা করেন।

এছাড়াও, তাঁরা ডিসকর্ড চ্যানেলের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ আদান-প্রদান করা হয়।

বছরে দু’বার, ক্লাবের সদস্যরা একটি বিশেষ রিট্রিটে মিলিত হন, যেখানে তাঁরা একসঙ্গে সময় কাটান, রান্না করেন, খেলাধুলা করেন এবং প্রকৃতির মাঝে নিজেদের দুঃখ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এই ক্লাবের প্রধান লক্ষ্য হল, শোকাহত পিতাদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করা, যেখানে তাঁরা তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন এবং অন্যদের কাছ থেকে সমর্থন পেতে পারেন।

এই সংগঠনটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সদস্যদের সহায়তা করে।

সদস্যদের জন্য বিনামূল্যে অনলাইন থেরাপি সেশনের ব্যবস্থা করা হয়, যা তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক।

যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ব্র্যাড বেইলি নামের এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর সন্তান রোহানকে জন্মের আগেই হারিয়েছিলেন, এই ক্লাবের মাধ্যমে গভীর মানসিক শান্তি খুঁজে পান।

তিনি বলেন, “নিজের সন্তানকে হারানোর যন্ত্রণা যারা অনুভব করেছেন, তারাই কেবল এর গভীরতা বুঝতে পারবেন।

আমি যখন একা ছিলাম, তখন মনে হতো, আমার পাশে কেউ নেই, কোনো পথ নেই।

কিন্তু এই ক্লাবের মাধ্যমে আমি নতুন করে বাঁচতে শিখেছি।”

‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা রব রাইডার মনে করেন, সন্তানের মৃত্যু একটি অন্তহীন যাত্রা।

তিনি বলেন, “এই শোকের সঙ্গে বাঁচতে শেখা কঠিন, কিন্তু একা সেই পথ পাড়ি দেওয়া আরও কঠিন।

সাহায্য পাওয়াটা যেন কোনো বোঝা না হয়, সেদিকে আমরা খেয়াল রাখি।”

বর্তমানে, এই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার।

ক্লাবের সদস্যরা সারা বিশ্ব থেকে, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও এই আলোচনা চক্রে যুক্ত হতে পারেন।

ভবিষ্যতে, এই সংগঠনটি আরও বেশি সংখ্যক পিতার কাছে পৌঁছাতে এবং তাঁদের জন্য আরও উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা করছে।

সন্তান হারানোর শোক কোনো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।

‘স্যাড ড্যাড্‌স ক্লাব’ সেই শোকের পথে পিতাদের জন্য এক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী, যা তাঁদের এই কঠিন সময়ে সাহস জোগায়, এবং নতুন করে বাঁচতে শেখায়।

তথ্যসূত্র: সিএনএন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *