দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষক হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা মন্তব্যকে ‘তথ্য বিকৃত’ বলে অভিহিত করেছেন দেশটির পুলিশ মন্ত্রী সেনজো মচুনু। খবর অনুযায়ী, হোয়াইট হাউসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসার সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প একটি ভিডিও দেখান, যেখানে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের সমাধিস্থল রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
পুলিশ মন্ত্রী মচুনু শুক্রবার জানান, ট্রাম্পের দেখানো ভিডিওটিতে সমাধিস্থল নয়, বরং ২০২০ সালে নিহত সকল কৃষকের স্মরণে তৈরি করা কিছু স্মৃতিচিহ্ন ছিল। তিনি বলেন, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য বিকৃত করে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের ওপর গণহত্যার মিথ্যা বয়ান তৈরি করেছেন।
বৈঠকে দেখানো ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি গ্রামীণ রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে সাদা ক্রস স্থাপন করা হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেন, এগুলো এক হাজারের বেশি শ্বেতাঙ্গ কৃষকের সমাধিস্থল। তিনি আরও বলেন, “এখানে সমাধিস্থলগুলো রয়েছে, শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের কবর দেওয়া হয়েছে এবং রবিবার সকালে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল।”
মচুনু জানান, ওই ক্রসগুলো কোনো কবর বা সমাধিস্থল ছিল না। এগুলো ছিল ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে সকল কৃষক হত্যার প্রতিবাদে নির্মিত একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ। একটি শ্বেতাঙ্গ দম্পতির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিছিলের সময় এগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।
নিহত ওই দম্পতির এক ছেলে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের একজন সদস্যও নিশ্চিত করেছেন যে, ক্রসগুলো কোনো সমাধিস্থল নয় এবং প্রতিবাদের পর তা সরিয়ে নেওয়া হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় সহিংস অপরাধের হার অনেক বেশি। যদিও কৃষক হত্যা দেশটির মোট হত্যাকাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র অংশ। শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকরাই হামলার শিকার হন এবং কখনো কখনো নিহতও হন। সরকার উভয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ৬ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা প্রায় ৭ শতাংশ। তবে বর্ণবৈষম্য বিলুপ্তির ৩০ বছর পরেও শ্বেতাঙ্গদের জীবনযাত্রার মান কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে অনেক ভালো। দেশটির ধনী বাণিজ্যিক কৃষকদের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ।
মচুনু আরও বলেন, ট্রাম্পের এই মিথ্যা দাবি, যেখানে তিনি ১,০০০ জনের বেশি মানুষের সমাধিস্থলের কথা বলেছেন, তা গণহত্যার গল্পের একটি অংশ। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ট্রাম্প ভিত্তিহীনভাবে অভিযোগ করেছেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের হত্যা ও তাদের জমি দখলের একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া চলছে, যা গণহত্যার শামিল।
ট্রাম্পের এমন অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় মচুনু বলেন, “ওগুলো কোনো কবর নয়। ওগুলো সমাধিস্থলও নয়। আর এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, দক্ষিণ আফ্রিকার অপরাধ সম্পর্কে মিথ্যা বয়ান তৈরি করতে তথ্যগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে।
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। তবে তার গণহত্যার গল্পের প্রতি আমাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই।”
হোয়াইট হাউস অবশ্য মচুনুর মন্তব্যের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে এর আগে, প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট তার ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, “ভিডিওটিতে ক্রসগুলো এমন লোকদের প্রতিনিধিত্ব করে, যারা তাদের সরকারের দ্বারা জাতিগতভাবে নির্যাতিত হয়েছে।”
জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় সংঘটিত ৫,৭০০-এর বেশি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৬টি ছিল খামারে সংঘটিত এবং এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ছিলেন একজন। মচুনু বলেন, “মূলত, আমরা মানুষকে জাতিগতভাবে শ্রেণিবদ্ধ করি না। তবে শ্বেতাঙ্গদের গণহত্যা বিষয়ক দাবির প্রেক্ষাপটে, আমাদের এই শ্রেণির হত্যাকাণ্ডগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।”
লরেন্স বসমান নামে দেশটির সাবেক এক সংসদ সদস্য জানান, তিনি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্বাঞ্চলীয় কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশের নিউক্যাসল শহরের কাছে হওয়া ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন, যা ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ভিডিওতে দেখিয়েছে। বসমান আরও বলেন, ক্রসগুলো শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ কৃষক ও খামার শ্রমিকদের প্রতীক ছিল, যারা বিগত ২৬ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে নিহত হয়েছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ট্রাম্পের এই অভিযোগকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন ও হত্যার পেছনে সরকারের মদদ রয়েছে—ট্রাম্পের এমন দাবি ভিত্তিহীন এবং ভুল তথ্যের ওপর নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রপতি রামাপোসা মূলত ট্রাম্পের সঙ্গে এই বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন, যাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে ট্রাম্পের ভুল ধারণাগুলো দূর করা যায় এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন করা যায়।
উল্লেখ্য, গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সকল আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। তিনি দেশটির শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান কৃষক ও তাদের জমি দখলের অভিযোগও করেন। ওই আদেশে রামাপোসার সরকারের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ ভূমি মালিকদের ওপর ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ সহিংসতা’র উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে আরও অভিযোগ করা হয় যে, দক্ষিণ আফ্রিকা একটি ‘মার্কিন-বিরোধী’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করা হয়। ওই আদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাসকে সমর্থন করারও অভিযোগ আনা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: Associated Press