যুদ্ধ কি শুধু অস্ত্রের? নাকি যুদ্ধের আসল ময়দানটা অন্য কোথাও? সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে তাকালে এমন প্রশ্ন জাগে।
কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে গোলাগুলি চললেও, আসল যুদ্ধটা যেন চলছিল খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায়, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এই ‘ডিসকারসিভ ওয়ারফেয়ার’ বা ভাষাগত যুদ্ধের ধারণা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভাষ্য, যা দুই দেশের মধ্যে ঘৃণা ও বিভেদ তৈরি করছে।
মে মাসের শুরুতে, ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ শুরু করে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান চালায় ‘অপারেশন বানিয়ান-উম-মারসুস’। সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
কিন্তু নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, এই সামরিক কার্যকলাপের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল দুই দেশের মিডিয়াতে প্রচারিত খবর, যা আসলে যুদ্ধের একটি অংশ ছিল।
ভারতীয় মিডিয়া প্রচার করে যে, তারা সন্ত্রাস দমনের জন্য অভিযান চালিয়েছে।
তাদের ভাষ্যে, এটি ছিল ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ২.০’। হামলায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং এতে কোনো বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ভারতের পক্ষ থেকে একে ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের মিডিয়া ভারতীয় হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বর্ণনা করে এবং বেসামরিক হতাহতের খবর প্রচার করে।
তাদের দাবি, প্রতিশোধ হিসেবে তারা জবাব দিয়েছে।
এই দুই ধরনের ভাষ্যের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
উভয় দেশই নিজেদেরকে শান্তিরক্ষক হিসেবে তুলে ধরে এবং অন্যকে আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে।
ভারত পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করে, যেখানে পাকিস্তানের পরিচয়কে খাটো করে দেখানো হয়।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ভারতকে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করে, যারা মুসলিমদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চায়।
মিডিয়ার এই দ্বিমুখী প্রচারণার কারণে, উভয় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ বাড়ে।
সংলাপের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং যুদ্ধ আরও সম্ভাব্য হয়ে ওঠে।
উভয় দেশের মিডিয়া, নিজেদের দেশের নিহতদের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও, প্রতিপক্ষের হতাহতদের প্রতি ছিল এক ধরনের উদাসীনতা।
এই ঘটনাগুলো আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।
দক্ষিণ এশিয়ায়, সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্রটি হলো পারমাণবিক বোমা নয়, বরং সেই ভাষ্য, যা যুদ্ধের বীজ বপন করে।
এই ধরনের ভাষ্য তৈরি হয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে, যা মানুষের মনে ঘৃণা ও বিভেদ সৃষ্টি করে।
অতএব, যখন আমরা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা দেখি, তখন শুধু কে প্রথম গুলি ছুড়েছিল, সেই প্রশ্ন করাই যথেষ্ট নয়।
বরং, কোন পক্ষ কী কথা বলছে, এবং সেই কথার মাধ্যমে তারা কী বোঝাতে চাইছে, সেটিও আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা