আশ্চর্য! কীভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমুদ্র জয় করছেন কোরিয়ার সাহসী নারীরা?

দক্ষিণ কোরিয়ার একটি দ্বীপ, যার নাম জেজু। এই দ্বীপের নারীরা যুগ যুগ ধরে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এদের বলা হয় ‘হায়েনিও’, যার অর্থ ‘সমুদ্রের নারী’। কোনো শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র ছাড়াই তারা সাগরের নিচে নেমে আসে এবং নানা ধরনের সামুদ্রিক খাবার সংগ্রহ করে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় তাদের এই বিশেষ ক্ষমতার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।

জেজু দ্বীপ কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত। এখানকার নারীরা বছরের পর বছর ধরে, এমনকি গর্ভবতী অবস্থায়ও, গভীর সমুদ্রে ডুব দেন। তারা প্রায় ৬০ ফুট গভীর পর্যন্ত ডুব দিতে পারেন।

তাদের এই কাজে কোনো বিশেষ সরঞ্জাম লাগে না, শুধু একটি ওয়েটস্যুট পরেই তারা সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা ধরে তারা এভাবে কাজ করেন। বিজ্ঞানীরা জানতে চান, কীভাবে তারা এত কষ্টসহিষ্ণুতার সাথে এই কাজ করেন। তাদের এই ক্ষমতা কি বংশগত, নাকি কঠোর প্রশিক্ষণের ফল? নাকি দুটোই?

উতাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞানী মেলিসা অ্যান ইলার্ডো এবং তার সহকর্মীরা এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণার ফল ‘সেল রিপোর্টস’ নামক বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

তারা দেখেছেন, হায়েনিও নারীদের মধ্যে কিছু বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের সমুদ্রের নিচে দীর্ঘ সময় ধরে থাকতে সাহায্য করে। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা ৩০ জন হায়েনিও, জেজুর আরও ৩০ জন নারী এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ভূখণ্ডের ৩১ জন নারীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ছিল ৬৫ বছর।

তাদের হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ এবং প্লীহার আকার পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও, তাদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়।

গবেষকরা দেখেছেন, জেজুর নারীদের মধ্যে, যারা ডুব দেন এবং যারা দেন না, উভয়ের মধ্যেই এমন একটি জিনের উপস্থিতি বেশি, যা নিম্ন রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইলার্ডো ব্যাখ্যা করেন, “ডুব দেওয়ার সময় রক্তচাপ বাড়ে, কিন্তু জেজুর নারীদের ক্ষেত্রে এটি তুলনামূলকভাবে কম বাড়ে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বৈশিষ্ট্য সম্ভবত তাদের শিশুদের রক্ষার জন্য বিবর্তিত হয়েছে, কারণ হায়েনিও নারীরা গর্ভাবস্থায়ও ডুব দেন।

এছাড়াও, জেজুর নারীদের মধ্যে এমন একটি জিনের ভিন্নতা পাওয়া গেছে, যা ঠান্ডা এবং ব্যথার প্রতি সহনশীলতা তৈরি করতে পারে। যদিও গবেষকরা সরাসরি তাদের ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা পরিমাপ করেননি, তবে তাদের ধারণা, এটি বছরজুড়ে ডুব দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

হায়েনিওদের এই বিশেষ ক্ষমতা শুধু জিনগত কারণে নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ডুবুরি নারীদের হৃদস্পন্দন, যারা ডুব দেন না তাদের তুলনায় ধীরগতির। ইলার্ডো বলেন, “তাদের হৃদস্পন্দন পরীক্ষার সময় প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আমরা জানি, এটি প্রশিক্ষণের কারণে হয়েছে।

আগের একটি গবেষণায়, ইলার্ডো ইন্দোনেশিয়ার বাজাউ সম্প্রদায়ের ডুবুরিদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। বাজাউ সম্প্রদায়ের মানুষেরা অক্সিজেনের অভাব সহ্য করতে পারে, যার কারণ তাদের শরীরে কিছু জিনগত পরিবর্তন। তাদের প্লীহার আকারও স্বাভাবিকের চেয়ে বড়।

গবেষক বেন ট্রাম্বলের মতে, হায়েনিওদের শরীরে পাওয়া যাওয়া নিম্ন রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনটি নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “যাদের এই জিন আছে, তাদের রক্তচাপ ১০ শতাংশের বেশি কমে যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে হায়েনিওদের সংখ্যা কমে আসছে। তরুণীরা আর এই পেশায় আসতে চাইছে না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বর্তমান হায়েনিওরাই সম্ভবত শেষ প্রজন্ম। তাই, এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা এবং তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে আরও গবেষণা করা জরুরি। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা যেতে পারে।

তথ্য সূত্র: CNN

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *