স্পেনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে জনবসতি ছিল খুবই কম, সেখানে কীভাবে সমকামীদের বিয়ের আসর বসতে শুরু করলো, সেই গল্প শুনলে হয়তো অনেকেরই ভালো লাগবে। মাদ্রিদ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে এ২ মোটরওয়ে ধরে গেলেই চোখে পড়ে শিল্পাঞ্চল আর গাড়ির অবিরাম স্রোত।
কিন্তু পেনারুবিয়া পার হওয়ার পরেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ব্যস্ত রাস্তা, কলকারখানা—সবকিছু যেন মিলিয়ে যায়। এরপরই গুয়াডালাহার প্রদেশ, যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র পাঁচজন মানুষের বাস।
একে বলা হয় “ইউরোপের সবচেয়ে জনশূন্য এলাকা”। স্থানীয় ভাষায় একে ‘লা এস্পানা ভাচিয়া’ বা “খালি স্পেন” বলা হয়।
তামাহন শহর পেরিয়ে, সিয়েরা নোরতে দে গুয়াডালাহার প্রাকৃতিক উদ্যানের দিকে একটি সরু পথ বয়ে গেছে, যা প্রাচীন ওক এবং জুনিপার গাছের বনভূমি দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
এখানকার ওসেখন পাহাড়ের উচ্চতা ২০৪৬ মিটার, আর শীতকালে এর চূড়ায় বরফের আস্তরণ দেখা যায়। একসময় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আইবেরিয়ান নেকড়ে বাঘও এখন এই অঞ্চলে ফিরে এসেছে।
এই নির্জন ভূমিই ছিল এক অসাধারণ সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী। ২০০৫ সালের জুনে, হোসে লুইস স্যাপাতেরো-র নেতৃত্বে স্পেনের সমাজতান্ত্রিক সরকার সমকামীদের বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেয়।
এরপরে, কিছু রক্ষণশীল মেয়র তাঁদের শহরে এই ধরনের বিয়ের অনুমতি দিতে রাজি হননি। তবে গুয়াডালাহার ক্যাম্পিলো দে রানাস-এর মেয়র ফ্রান্সিসকো মারোটো এগিয়ে আসেন।
খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পরে, কারণ ২০০৭ সালে আন্দ্রেস রুবিও’র তৈরি করা “ক্যাম্পিলো সি, কুইয়েরো” (ক্যাম্পিলো, হ্যাঁ, আমি রাজি) নামের একটি তথ্যচিত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপরই, জনমানবশূন্য এই গ্রামে, যেখানে মাত্র কয়েক ডজন মানুষের বাস, সেখানে সমকামী যুগলদের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে।
২০০৫ সালের আইনের সুফলভোগী হিসেবে, আমি নিজেও আমার স্প্যানিশ সঙ্গীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। তাই ক্যাম্পিলো দে রানাস-এর গল্পটা আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করত।
গ্রামটি ঘুরে দেখার জন্য তাই ২০২০ সালটা ছিল উপযুক্ত সময়।
দৃশ্যটা যেন দু’পাশ থেকে টেনে লম্বা করা হয়েছে—এমনই লাগছিল। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পেরোতে একটিও গাড়ি চোখে পড়েনি। এখানকার সংকীর্ণ রাস্তাগুলোতে গরুর পাল দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, যেন তারাই এখানকার পথের রাজা।
পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গ্রামগুলো, যাদের ঘরবাড়িগুলো তৈরি হয়েছে পাথরের স্লেট দিয়ে, চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই গ্রামগুলোকে ‘পুয়েবলোস নেগ্রোস’ বা “কালো গ্রাম” বলা হয়।
২০০৫ সাল থেকে, এই গ্রামে এক হাজারের বেশি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে, যেখানে জাপান, আইসল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও সমকামী দম্পতিরা এসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। মেয়র মারোটো তাঁর অফিসে বসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়েই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।
তবে এমনটা হবে, তা ভাবিনি।” বিয়ের কারণে প্রায় ১৫০ জন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হতো, আর তাঁদের পরিবেশন করার জন্য ১৬ জন লোক নিয়োগ করতে হয়েছিল।
ক্যাম্পিলো দে রানাস-এর অর্থনীতিতে এই বিয়ের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে এখানে ১৯টি “কাসা রুরাল” (গ্রামীণ গেস্টহাউস) এবং পাঁচটি রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে বিবাহের অনুষ্ঠানগুলি নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হয়।
বিয়ের অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের মাধ্যমে এখানকার ব্যবসার প্রচার হয়, যার ফলে আরো অনেক যুগল এখানে আসতে শুরু করে। এমনকি গ্রামের প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ির মালিক এখন বাইরের লোক।
মারোটো এবং তাঁর সঙ্গীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলেও, কুইক এখনো ক্যাম্পিলোতেই থাকেন। তিনি একটি জনপ্রিয় বিয়ের স্থান, আল্ডেয়া তেজেরা নেগ্রা-র দেখাশোনা করেন।
কুইক জানান, এখানে সমকামী এবং বিপরীত লিঙ্গের যুগলদের বিয়ে হয়, যেখানে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। এখানে সবাই বহিরাগত—এটাই যেন মূল পরিচয়।
ক্যাম্পিলোর কাছাকাছি অবস্থিত ক্যাম্পিলেইজো গ্রামের বাড়িগুলোও স্লেট দিয়ে তৈরি। এখানকার নীরবতা যেন গভীর। লস মাঞ্জানোস নামের একটি রেস্তোরাঁতে বসে আমরা স্থানীয় গরুর মাংস দিয়ে তৈরি খাবার খেয়েছিলাম।
এখানকার মালিক ডেভিড গার্সিয়া-আলকালা কুয়েঙ্কা জানিয়েছিলেন, ফ্রান্সিসকো মারোটো-ই তাঁদের বিয়ে পড়িয়েছিলেন।
ক্যাম্পিলো দে রানাস-এর এই গল্প, গ্রামীণ পুনরুজ্জীবন এবং পর্যটনের মাধ্যমে একটি জনশূন্য এলাকার ঘুরে দাঁড়ানোর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেখানে এই ধরনের ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান