যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত একটি ইসরায়েলি কোম্পানির তৈরি করা স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ইউরোপের বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছে। কানাডার সিটিজেন ল্যাব নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এসেছে।
খবর অনুযায়ী, কমপক্ষে তিনজন সাংবাদিককে টার্গেট করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে ইতালির একটি অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যমের দুইজন সম্পাদকও রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসরায়েলি কোম্পানি প্যারাগন সলিউশনস-এর তৈরি ‘গ্রাফাইট’ নামের স্পাইওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনার জেরে ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাণিজ্যিক স্পাইওয়্যার-এর অপব্যবহার নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারির ঘটনায় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এমন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, “যদি এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। সাংবাদিকদেরসহ নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যে অবৈধভাবে প্রবেশ করার যে কোনো অপচেষ্টা আমরা বরদাস্ত করব না।
এই বিষয়ে ইইউ আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কমিশন তার সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করবে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা আইন মেনেই কাজ করে এবং সাংবাদিকদের ওপর কোনো অবৈধ নজরদারি চালানো হয়নি।
প্যারাগন সলিউশনস নিজেদের একটি নির্ভরযোগ্য কোম্পানি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে, যারা স্পাইওয়্যার শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করারও চেষ্টা করছে তারা।
জানা গেছে, সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের সমর্থনপুষ্ট প্যারাগনকে সম্প্রতি একটি প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে।
মেটা (ফেসবুকের মূল সংস্থা) জানুয়ারিতে জানায়, প্যারাগনের গ্রাফাইট স্পাইওয়্যার প্রায় দুই ডজনের বেশি দেশের প্রায় ৯০ জন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর ফোনে আড়ি পাতার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর থেকেই কারা হ্যাক হয়েছে এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
হোয়াটসঅ্যাপের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা দেখেছি, কীভাবে বাণিজ্যিক স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে। এই ধরনের কোম্পানির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মেটা ইতিমধ্যেই এই দুর্বলতা সারিয়ে তুলেছে এবং পরবর্তীতে আর কোনো আক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে প্যারাগনকে একটি আইনি নোটিশও পাঠানো হয়েছে।
এর আগে, ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের তৈরি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ১,৪০০ হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার অভিযোগে মেটা একটি মামলায় জয়ী হয়, যেখানে এনএসও গ্রুপকে ১৬৮ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।
হ্যাক হওয়া অ্যাকাউন্টগুলোর মধ্যে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের অ্যাকাউন্টও ছিল।
সিটিজেন ল্যাবের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পরেও সাংবাদিকদের ওপর স্পাইওয়্যার ব্যবহারের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। তাদের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, প্যারাগন সফলভাবে অ্যাপলের ডিভাইসগুলোতেও আড়ি পাততে সক্ষম হয়েছে।
ইতালির অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম ফ্যানপেজ.ইট-এর নাপোলি অফিসের প্রধান সিরো পেলেগ্রিনো এপ্রিল মাসের শেষের দিকে জানতে পারেন যে তার আইফোন হ্যাক করা হয়েছে। ফ্যানপেজের প্রধান সম্পাদক ফ্রান্সেসকো কানসেল্লাটোর অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসও প্যারাগনের স্পাইওয়্যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল।
সিটিজেন ল্যাবের গবেষকদের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, একজন “বিশিষ্ট ইউরোপীয় সাংবাদিক”-এর ফোনেও আড়ি পাতা হয়েছিল। যদিও ওই সাংবাদিকের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
সিটিজেন ল্যাব জানিয়েছে, আক্রমণের মূল উৎস ছিল আই-মেসেজ এবং অ্যাপল তাদের নিরাপত্তা দুর্বলতা সারিয়ে নিয়েছে।
সিটিজেন ল্যাবের একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক জন স্কট-রেলটন বলেছেন, “প্যারাগন এখন সেই একই ধরনের অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত, যার জন্য এনএসও গ্রুপ কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
এটি প্রমাণ করে যে সমস্যাটা আসলে পুরো শিল্পের, কিছু খারাপ মানুষের নয়।
প্যারাগনের স্পাইওয়্যার এতটাই শক্তিশালী যে ব্যবহারকারীর কোনো রকম সক্রিয়তা ছাড়াই এটি ডিভাইসে প্রবেশ করতে পারে।
এনএসও গ্রুপের তৈরি কুখ্যাত পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতোই গ্রাফাইট ব্যবহার করে গোপনে অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে প্রবেশ করা যায়, এমনকি সিগন্যাল এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপও এর থেকে সুরক্ষিত নয়।
ইতালির পার্লামেন্টারি কমিটি (COPASIR) প্যারাগনের ব্যবহারের বিষয়ে সরকারের তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইতালীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কানসেল্লাটোর ওপর নজরদারি চালায়নি। তবে, তারা সুশীল সমাজের কর্মীদের ওপর গ্রাফাইটের মাধ্যমে নজরদারি করেছে, তবে তা ছিল সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে এবং অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে।
প্যারাগন এবং ইতালির মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলেও, উভয় পক্ষই ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখাচ্ছে।
প্যারাগন তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, তারা কানসেল্লাটোর ঘটনার তদন্তে সহায়তা করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইতালি সরকার তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
অন্যদিকে, ইতালীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, জাতীয় নিরাপত্তার কারণে তারা প্যারাগনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং গণমাধ্যমের সমালোচনার পরেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও প্যারাগনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। গত বছর, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (DHS) তাদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্যারাগনকে ২ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি দেয়।
এছাড়া, মাদক নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনও এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস