বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ স্টিভ রাইখ: শিল্পের সীমাবদ্ধতা এবং সঙ্গীতের জগৎ।
সঙ্গীতের জগতে ‘মিনিমালিস্ট’ ধারার অন্যতম পথিকৃৎ স্টিভ রাইখ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর সঙ্গীত জীবন, বিভিন্ন প্রভাবশালী শিল্পী এবং শিল্পের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন।
রাইখের মতে, ‘মিনিমালিস্ট’ সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য হলো এর পুনরাবৃত্তি। তাঁর কাজের ধরন এমন যে, সুরের পরিবর্তনগুলো খুব ধীরে আসে। তাঁর বিখ্যাত কিছু কাজের মধ্যে রয়েছে ‘ইটস গনা রেইন’ (It’s Gonna Rain) এবং ‘পিয়ানো ফেজ’ (Piano Phase)।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, “এসব শুনে কি হবে?”, কিন্তু যারা শোনেন, তাঁরা অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
ডেভিড বোয়ির সঙ্গে তাঁর কাজের একটা যোগসূত্র ছিল। রাইখের ‘ক্ল্যাপিং মিউজিক’ (Clapping Music) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বোয়ির ‘লাভ ইজ লস্ট’ (Love Is Lost) গানটি রিমেক করেন জেমস মারফি। ১৯৭৮ সালে নিউইয়র্কের একটি কনসার্টে বোয়ির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের আদান-প্রদান হয়েছিল, যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সঙ্গীতের সরঞ্জাম কেনার প্রসঙ্গে তিনি জানান, তাঁর ড্রাম কিটের জন্য ১৯৫২ বা ১৯৫৩ সালে কেনা একটি ২১ ইঞ্চির জিল্ডজিয়ান রাইড সিম্বাল ছিল তাঁর গর্ব। এছাড়া, তিনি যখন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, জুইলিয়ার্ড এবং মিলস কলেজে সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তখন চারটি বংগো ড্রাম এবং তিনটি ম্যারিম্বা কিনেছিলেন।
তাঁর বন্ধু, শিল্পী সল লেভিট কিছু সঙ্গীতের স্বরলিপি কিনেছিলেন, যার থেকে পাওয়া অর্থে তিনি তিনটি গ্লোকেন্স্পিল কিনেছিলেন, যা ‘ড্রামিং’ (Drumming) -এর কাজে লাগে।
তাঁর সঙ্গীতজীবন শুরু করার দিনগুলোতে, তিনি এবং ফিলিপ গ্লাস দুজনেই ম্যানহাটনের লোয়ার ইস্ট সাইডে ভারী আসবাবপত্র সরানোর কাজ করতেন। তাঁরা একটি মুভিং কোম্পানি খুলেছিলেন, নাম ছিল ‘চেলসি লাইট মুভিং’। কিন্তু এই কাজটি ছিল খুবই কষ্টকর।
২০১৪ সালে ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে আবার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে রাইখ বলেন, তাঁরা একসঙ্গে জুইলিয়ার্ডে পড়াশোনা করেছেন। পরে গ্লাস তাঁর কনসার্টে এসে তাঁর কাজ পছন্দ করেন এবং একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন।
এরপর তাঁরা বিভিন্ন কনসার্টে অংশ নিতেন। একসময় তাঁদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও, ২০১৪ সালে একটি অনুষ্ঠানে তাঁদের আবার দেখা হয় এবং একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়।
স্টিভ রাইখ তাঁর জীবনে গ্রেটফুল ডেডের (Grateful Dead) ফিল লেশের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। মিলস কলেজে লুসিয়ানো বেরিওর একটি ক্লাসে তাঁদের পরিচয় হয়।
তাঁরা একসঙ্গে ইলেক্ট্রনিক্সের ওপর কাজ করেছেন। সেই সময় লেশ ট্যাক্সি চালাতেন আর রাইখ পোস্ট অফিসে কাজ করতেন। ভালো একটি টেপ রেকর্ডার কেনার জন্য তাঁরা দুজনেই তাঁদের উপার্জিত অর্থ একত্র করতেন।
পরে লেশ যখন গ্রেটফুল ডেডের বেসিস্ট হন, তখন তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়।
সমসাময়িক ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত এবং বিশেষ করে মিনিমালিস্ট ঘরানার শিল্পীরা ডিস্কো বা পাঙ্ক রক শোনেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে রাইখ জানান, তিনি এবং ফিল লেশ দুজনেই বিটলস-এর গান শুনতেন।
তবে পাঙ্ক বা ডিস্কো তাঁকে সেভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। পরবর্তীকালে রেডিওহেড (Radiohead) তাঁকে মুগ্ধ করে। রেডিওহেডের জনি গ্রিনউড তাঁর ‘ইলেকট্রিক কাউন্টারপয়েন্ট’ (Electric Counterpoint) -এর একটি সংস্করণ তৈরি করেন, যা রাইখের খুব ভালো লেগেছিল।
এরপর তিনি রেডিওহেডের দুটি গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘রেডিও রিরাইট’ (Radio Rewrite) তৈরি করেন।
দীর্ঘ সময় ধরে গান শোনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর মতে কিছু গান সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত, যেমন ‘ক্ল্যাপিং মিউজিক’। আবার ‘মিউজিক ফর ১৮ মিউজিশিয়ান্স’-এর মতো গানগুলো প্রায় ৫৫ মিনিটের হওয়া উচিত।
শিল্পের রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে রাইখ বলেন, “আমরা সবাই চাই শিল্প যেন মার্কিন রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা পারে না।” তিনি স্পেনের গুয়ের্নিকা শহরের বোমা হামলার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যার প্রতিক্রিয়ায় পিকাসো ‘গুয়ের্নিকা’ (Guernica) তৈরি করেন।
কিন্তু এর পরেও ড্রেসডেন, নাগাসাকি, হিরোসিমা এবং ৯/১১-এর মতো ঘটনা ঘটেছে। তাই শিল্পের সীমাবদ্ধতাগুলো আমাদের বুঝতে হবে।
রাইখ তাঁর ইহুদি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। তিনি তাঁর সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় প্রকাশের একটি রূপ হিসেবে দেখেন। তাঁর ‘তেহিলিম’ (Tehillim) -এর মতো কাজে তিনি এই বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতের মধ্যে একটি সাধারণ দিক খুঁজে পাওয়া যায়। রাইখের মতে, এই সব ধরনের সঙ্গীতে একটি ‘হারমোনিক সেন্টার’ থাকে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান