৩৬ বছর বয়সে ভয়াবহ স্ট্রোকের পর কিভাবে নতুন করে হাঁটা, কথা বলা, এমনকি নাচের জগতে ফিরে এলেন এক নারী, সেই গল্প।
হঠাৎ করেই জীবনের ছন্দপতন। নাচের তালে যিনি ছিলেন সদা আত্মবিশ্বাসী, গানের সুরে যিনি শরীরী ভাষা ফুটিয়ে তুলতেন সাবলীলভাবে, সেই নারীর জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে বসবাস করা এই নারীর নাচের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। মিউজিক জার্নালিস্ট হিসেবে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কনসার্টে, ক্লাবে তাঁর অবাধ আনাগোনা ছিল।
গান ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর নাচের মাধ্যমে তিনি সেই গানের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতেন।
কিন্তু নিয়তি যেন অন্য কিছু লিখে রেখেছিল। জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, যখন তিনি তাঁর প্রথম বই প্রকাশের আনন্দে বিভোর, তখনই ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা।
বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে নাচের মাধ্যমে উদযাপন করছিলেন তিনি। এরপর একটি সকালে খবরের কাগজ কিনতে গিয়ে শরীরে অস্বস্তি অনুভব করেন।
হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, মস্তিষ্কের রক্তনালীতে ফাটল ধরেছে, যা থেকে স্ট্রোক হয়েছে।
চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এরপরে শুরু হয় দীর্ঘ এবং কঠিন এক যাত্রা।
অস্ত্রোপচার, সেরে ওঠার চেষ্টা, আর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লড়াই। একদিকে যেমন ছিল প্রিয়জনদের ভালবাসা, তেমনই ছিল শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা।
কথা বলতে পারতেন না, শরীরের ডান দিক ছিল নিস্তেজ। পরিচিত জগৎটা যেন ক্রমশই অচেনা হয়ে উঠছিল।
চিকিৎসার অংশ হিসেবে তাঁর মাথার খুলির কিছু অংশ অপসারণ করা হয়েছিল, যা তাঁর সেরে ওঠার পথে আরও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে তিনি তাঁর মায়ের কথা শুনতেন, যিনি তাঁর পায়ে মালিশ করতেন। ধীরে ধীরে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছিলেন, কিন্তু স্মৃতিগুলো যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।
চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তিনি ফিজিক্যাল থেরাপি এবং স্পিচ থেরাপির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে তিনি কথা বলতে শুরু করেন, যদিও প্রথমে তা ছিল অস্পষ্ট।
পরিচিত শব্দগুলো নতুন করে শেখা এবং সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করা ছিল তাঁর কাছে এক নতুন জগৎ।
হাসপাতালে কাটানো দিনগুলোতে তাঁর স্বামী এবং মা-বাবা নিয়মিত তাঁর পাশে থাকতেন, যা তাঁকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছিলেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছিলেন।
হাসপাতাল থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়ার পর তাঁর জীবনে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। সেখানে তিনি অন্যান্য রোগীদের সাথে মিশে যান এবং তাদের কাছ থেকে জীবনের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পান।
পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকাকালীন, তিনি সময়কে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করেন। তাঁর মনে হতে থাকে, সময় যেন তাঁর হাত থেকে পিছলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন এবং সময়ের ধারণা, সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানতে চেষ্টা করেন।
তাঁর বন্ধুদের পাঠানো একটি পত্রিকা ছিল তাঁর কাছে অমূল্য সম্পদ, যা তাঁকে বাইরের জগতের সাথে পরিচয় করিয়েছিল।
দিনের পর দিন তিনি সুস্থ হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হাঁটাচলার ক্ষমতা ফিরে পান।
হুইলচেয়ার থেকে ওয়াকার, ক্রাচ এবং অবশেষে একটি ভাঁজ করা লাঠির মাধ্যমে তাঁর চলাচলের স্বাধীনতা আসে। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর এই যাত্রায় ধৈর্য এবং চেষ্টা দুটোই অপরিহার্য।
অবশেষে, তিনি যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁর শরীরে লেগেছিল পরিবর্তনের ছোঁয়া। প্রিয়জনেরা তাঁকে নতুন করে জীবন শুরু করতে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ধীরে ধীরে তিনি নাচের ক্লাসে যোগ দেন এবং নতুন করে শরীরকে অনুভব করতে শুরু করেন।
তিনি বুঝতে পারেন, শারীরিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জীবনকে উপভোগ করার অনেক উপায় আছে।
বর্তমানে তিনি তাঁর পুরনো পেশায় ফিরে এসেছেন। লেখালেখি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি তাঁর জীবনকে আরও অর্থবহ করে তুলেছেন। তিনি এখন জানেন, অতীতের সেই কঠিন সময়গুলো তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এই কঠিন যাত্রাপথে তিনি উপলব্ধি করেছেন, জীবনের উত্থান-পতন সত্ত্বেও ভালোবাসার গুরুত্ব এবং পরিবারের সমর্থন কতটা জরুরি। তাঁর এই গল্প, আমাদের সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তথ্য সূত্র: The Guardian