যুদ্ধ বাড়ছে সুদানে, ড্রোন ও সোনার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আঞ্চলিক সম্পর্ক। সুদানের গৃহযুদ্ধ ক্রমশ তীব্র রূপ নিচ্ছে, যার মূল কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে দুই পক্ষের— সুদানি সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) ও র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ)-এর ড্রোন ব্যবহার বৃদ্ধি।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে।
গত ৪ মে, আরএসএফ পোর্ট সুদানে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালায়, যা বর্তমানে সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর পরেই সুদানি সামরিক বাহিনী তাদের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী ইউএই-এর বিরুদ্ধে আরএসএফকে সহায়তা করার অভিযোগ তোলে।
তারা আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুমকি দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানা যায়, ড্রোন হামলার কারণে শহরটিতে ব্যাপক লোকজনের স্থান ত্যাগ করতে হয়েছে। সুদানের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই বন্দর নগরী একসময় শান্ত ছিল, কিন্তু এখন যুদ্ধের আগুনে জ্বলছে।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যখন এসএএফ এবং আরএসএফ-এর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন সেনাবাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ছিল, যা তাদের আকাশপথে সুবিধা এনে দেয়। কিন্তু বর্তমানে আরএসএফ-এর হাতে আসা অত্যাধুনিক আত্মঘাতী ড্রোনগুলো পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।
তারা একটানা ছয় দিন ধরে পোর্ট সুদানে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ছিল একটি সামরিক ঘাঁটি, একটি বেসামরিক বিমানবন্দর, কয়েকটি হোটেল এবং একটি জ্বালানি ডিপো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত কয়েক মাস ধরেই সুদানে ড্রোন যুদ্ধের বিস্তার ঘটেছে। সেনাবাহিনী প্রধানত তুরস্ক থেকে কেনা সাশ্রয়ী মূল্যের ‘বায়রাকতার টিবি২’ ড্রোন ব্যবহার করছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তারা তুরস্ক থেকে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ড্রোন সংগ্রহ করেছে। এই ড্রোনগুলো দীর্ঘ দূরত্বে ভারী বোমা বহন করতে পারে এবং তাদের সহায়তায় সেনাবাহিনী গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে খার্তুমসহ দেশটির পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরএসএফ চীনের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন, সুদানের সামরিক সরকার এবং অন্যান্য পর্যবেক্ষক দলগুলো অভিযোগ করেছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফকে এসব ড্রোন ও অন্যান্য অস্ত্র সরবরাহ করছে।
যদিও ইউএই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং একে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উভয় পক্ষের ড্রোন ব্যবহারের ফলে সংঘাত আরও বাড়ছে, যা বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ৬ মে, পোর্ট সুদানে সেনাবাহিনীর সমর্থনে থাকা কর্তৃপক্ষ আমিরাতের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়।
সুদানের সেনাবাহিনীর এমন সিদ্ধান্তকে তড়িঘড়ি নেওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, সুদানের সোনা ব্যবসার ওপর আমিরাতের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সুদানের বৃহত্তম সোনার খনি ‘কুশ’-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিকানা আমিরাতের একটি কোম্পানির হাতে।
এছাড়া, আমিরাতের ব্যাংকগুলো খার্তুম ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার ধারণ করে, যা বাস্তুচ্যুত সুদানি নাগরিক এবং সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য অর্থ স্থানান্তরের সুবিধা দিয়ে থাকে।
এছাড়াও, এল-নিলিন ব্যাংক, যা পোর্ট সুদানের আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনা করে, তারও মালিকানা আমিরাতের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদানের অর্থনীতির ওপর আমিরাতের নিয়ন্ত্রণ থাকায় এমন সিদ্ধান্ত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। সুদানের সেনাবাহিনী এখনো জানায়নি কবে নাগাদ তারা আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
সুদানি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এক ভিডিও বার্তায় মিলিশিয়া বাহিনী (আরএসএফ) এবং তাদের সাহায্যকারীদের পরাজিত করার অঙ্গীকার করেছেন।
অন্যদিকে, আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ইমেইলে জানিয়েছে, তারা পোর্ট সুদানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুদানের এই যুদ্ধ আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংকট গ্রুপের সুদানের বিশেষজ্ঞ অ্যালান বসওয়েল সতর্ক করে বলেছেন, সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন বাড়ানোর জন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো আরএসএফ-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
এর ফলে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়বে এবং সুদানের অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা